চন্দননগর, 25 নভেম্বর: ঋতুকালীন সমস্যা নিয়ে আজও অসচেতন গ্রামের মহিলারা । কেউ পয়সার অভাবে তো কেউ আবার ভয়ে পুরনো প্রথা থেকে বের হতে পারেননি এখনও । জরায়ুতে ক্যানসারের মতো মারণ রোগ ডেকে আনে এই সময়ের সুরক্ষাহীনতা ৷ নারীদের এই বিশেষ সময়ের কুসংস্কার দূর করতে ও স্বাস্থ্য সচেতন করতে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের জন্য রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচার করছেন চন্দননগরের গৃহশিক্ষক সুমন্ত বিশ্বাস (Padman of Bengal Sumanta Biswas Demands Sanitary Napkin to be Available in Ration Shop)।
সময় পেলেই পুরুলিয়া থেকে সুন্দরবন আদিবাসী ও গ্রাম্য মহিলাদের সচেতন করতে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ক্লাস নেন তিনি ৷ নিজ উদ্যোগে স্যানিটারি ন্যাপকিন (Sanitary Napkin)বিলি করেন । প্রায় আড়াই বছর ধরে সিঙ্গুর স্টেশন সংলগ্ন বস্তি ও চন্দননগরের সুভাষপল্লি এলাকার পরিচারিকাদের ন্যাপকিন দিয়ে আসছেন তিনি ৷ এই বস্তিকে মডেল হিসাবে তৈরি করতে চান সুমন্তবাবু (Sumanta Biswas)৷ তাঁর মূল লক্ষ্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের বহুল ব্যবহার ।
নারী স্বাস্থ্যের কথা ভেবে এটাকে রেশনিং আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছেন তিনি ৷ তার জন্য প্রধানমন্ত্রী-সহ মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রের শিশু ও নারী সুরক্ষা দফতরেও লিখিতভাবে আবেদন করেছেন । তাঁর মতে, গণবন্টন ব্যবস্থার মধ্যে এলে গ্রাম্য মহিলাদের ক্ষেত্রেও সহজলভ্য হবে স্যানিটারি ন্যাপকিন । কম দামে তা ব্যবহার করতে পারবেন মহিলারা ৷ ফলে রোগব্যাধি থেকেও রক্ষা পাবেন তাঁরা ৷ আর তাছাড়াও সরকারিভাবে রেশনিংয়ে তা দেওয়া হলে বিষয়টি নিয়ে ছুঁতমার্গও কমবে ৷ কমবে লজ্জাও ৷
আরও পড়ুন : ভারতের স্যানিটারি ন্যাপকিনেও বিদেশ নির্ভরতা !
তবে শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহারের সচেতনতায় নয়, স্কুল ও গ্রামে গ্রামে মহিলাদের কাছে গিয়ে মেন্সট্রুয়াল ক্লাসও করান তিনি ৷ ঋতুকালীন সময়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, পুজো বা যে কোনও শুভ অনুষ্ঠানে পিরিয়ড চলাকালীন মহিলাদের বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে প্রচার করেন সর্বদা । কিন্তু তাঁর বক্তব্য, একা সব কিছু করতে পারবেন না । এর জন্য সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে । স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে তা সারা দেশে রেশন ব্যবস্থায় আনতে হবে ৷
তবে রাজ্য ও কেন্দ্রের বিভিন্ন স্কুলে ন্যাপকিনের মেশিন বসানো হলেও তা রিফিলিংয়ের কারণে বন্ধ হয়ে আছে বহু জায়গায় । এই বিষয়ে জেলা প্রশাসনের তরফে জেলাশাসক পি দীপাপ প্রিয়ার সঙ্গে কথা বলা হলে তিনি জানান, তারকেশ্বরে একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করা হচ্ছে । এছাড়াও বিভিন্নভাবে প্রচার চলছে সারা বছর । আগামিদিনে সুমন্তবাবুর মতো মানুষের সঙ্গে এক যোগে কাজ করা হবে । এই স্যানিটারি ন্যাপকিন গণবন্টন ব্যবস্থায় আনতে রাজ্য সরকারের কাছে জানানোর আশ্বাসও দেন তিনি ৷
আরও পড়ুন : রিল লাইফের প্যাডম্যান ধরা দিলেন রিয়েল লাইফে, চিত্র জঙ্গলমহলের
2017 সালে ভারতের 35টি শহরে সমীক্ষা করা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হু'র (WHO)তরফে । সেখান থেকে জানা যায়, 45 শতাংশ মহিলা মনে করেন দেশে ঋতুস্রাব নিয়ে সামাজিক ছুঁতমার্গ আছে । 43 শতাংশ ভারতীয় মেয়েরা ঋতুকালে ন্যাপকিন পান না । ন্যাপকিন ব্যবহারকারীদের মধ্যে 67 শতাংশ মহিলাদের প্রায়শই চেয়ে চিনতে জোগাড় করতে হয় । তবে গত কয়েক বছরে কিছুটা উন্নতি হলেও অনেকাংশে এখনও ঘাটতি রয়ে গিয়েছে ৷
সেই জায়গা থেকে গৃহশিক্ষক সুমন্ত বিশ্বাস বলেন, "স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার করা আর্থিক বিষয়ের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে । সংস্কারের দিকে থেকেও পিছিয়ে রয়েছেন মহিলারা । তা দোকানে কেনার ক্ষেত্রে হোক ও পরিবারের কাউকে জানানো । আমি 12 বছর ধরে সমাজের এই ব্যাধির জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে সচেতনতার কাজ করছি ।"
তিনি আরও বলেন, "ভারতবর্ষে রেশন দোকানের মাধ্যমে ন্যাপকিনের বন্টন ব্যবস্থা করতে হবে । বহু মহিলা এখনও আছে প্রতিমাসে পয়সার জন্য কিনতে পারে না । রেশন ব্যবস্থার আওতায় আনলে অনেক মহিলা তা সুলভে ব্যবহার করতে পারবেন ৷ সচেতনতার প্রচারও হবে । আমি লকডাউনেও সাইকেল নিয়ে সিঙ্গুর-সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দিয়েছিলাম । চন্দননগর ভূসংকল্প নামে মেন্সট্রুয়াল ভ্রাম্যমান স্কুল করছি । যেহেতু আমার কাজের অনুপ্রেরণা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তাই তার জন্মদিনটিকে ঋতুকালীন শিক্ষা দিবস হিসাবে পালন করব । ইতিমধ্যেই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, নদিয়া, সুন্দরবন ও হুগলি-সহ বিভিন্ন জায়গায় আমরা এই ধরনের ভ্রাম্যমান স্কুল করছি । যাতে মহিলাদের ঋতুকালীন শিক্ষা দেওয়া যায়, সচেতন করা যায় ৷"
আরও পড়ুন : স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি করে মীনা মেহতা হয়ে উঠেছেন ‘‘প্যাড দাদি’’
এই বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা শুভনাথ মল্লিক বলেন, "সুমন্ত স্যার যা করছেন তা খুবই ভালো । সরকার যেমন রেশনে চাল-ডাল দিচ্ছে তেমনি স্যানিটারি ন্যাপকিন দিলে রোগ মুক্ত হবেন মহিলারা । ক্যানসারের মতো মারণ রোগ থেকেও বাঁচবে সকলে ।
সিঙ্গুরের স্টেশন সংলগ্ন বস্তিবাসী তারা ব্যাধের কথায়, আমরা আগে কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করতাম । গরিব মানুষ সেভাবে কিনতে পারতাম না । স্যর এসে আমাদের দিয়ে যান । আগে শরীরে অসুবিধা হত এখন সেটা হয় না । আমরা ভালো আছি ৷"
আরও পড়ুন : গরীবদের বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের আবেদন মানুষীর