নালিকুল ও কলকাতা, 3 সেপ্টেম্বর: দুর্গাপুজোর আগে (Durga Puja 2022) হাতে আর একমাসও বাকি নেই ৷ তাই ব্যস্ততা বেড়েছে হুগলির (Hogghly) নালিকুলের (Nalikul) সিংহবাড়ির (Singha Bari) ছেলেদের ৷ আর ক'দিন পরই কোমর বেঁধে 'মাঠে নামতে হবে' তাঁদের ৷ কারণ, মা আসছেন ৷ তাঁর আবাহন থেকে বিসর্জন, সবটাই সামলান বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ৷ এটাই এই বাড়ির রীতি ৷ পুজোর দিনগুলোয় মহামায়া যেমন সকলের সেবা পান, ঠিক তেমনই এই পরিবারের যাঁরা 'দুর্গা', যাঁরা সারাবছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে সকলের সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখেন, বাড়ির সেই মহিলা সদস্যদের এই সময়টায় 'ছুটি' ৷ তাঁরা পুজোর সমস্ত আনন্দ উপভোগ করেন ৷ কিন্তু, কাজকর্ম যা করার, তা করতে হয় বাড়ির ছেলেদেরই ৷
এই পরিবারেরই জামাই মনোজকুমার সরকার ৷ বিয়ের পর থেকে সিংহবাড়ির পুজোয় অংশ নেন তিনিও ৷ মনোজ জানালেন, এই সিংহরাই একটা সময় এই এলাকার জমিদার ছিলেন ৷ সেই জমিদারি স্থাপন করেছিলেন কালীকুমার সিংহ ৷ পরবর্তীতে তিনি ও তাঁর পুত্র সনাতন সিংহ কুলদেবতা রঘুনাথজির মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ৷ সেখানে নিত্যপুজো হত ৷
আরও পড়ুন: হুগলি জেলায় হেরিটেজ শোভাযাত্রায় জ্যান্ত দুর্গা
কথিত আছে, কালীকুমারের মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র (সনাতন সিংহের ছেলে) এককড়িনাথ সিংহ স্বপ্নাদেশ পান ৷ পরিবারের সদস্যদের দাবি, স্বয়ং মহিষাসুরমর্দিনী তাঁকে দর্শন দিয়েছিলেন ! এককড়িনাথকে তাঁর পুজো করার নির্দেশ দিয়েছিলেন দেবী ৷ তবে, এককড়িনাথ যাঁকে স্বপ্নে দেখেছিলেন, মহামায়ার সেই রূপ ছিল চতুর্ভূজা ৷ তাই আজও এখানে দুর্গার যে প্রতিমা তৈরি করা হয়, তাঁর হাতের সংখ্যা দশের বদলে চার ৷ পুজোর বয়স আড়াইশো ছড়িয়েছে ৷
প্রতি বছর শারদোৎসবের ঠিক আগেই রঘুনাথজির মন্দিরে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয় ৷ তার পরদিনই দুর্গা প্রতিমার কাঠামো পুজো করেন পুরোহিত ৷ মায়ের বোধন হয় মহাষষ্ঠীতে ৷ নিরঞ্জন দশমীতে ৷ মহাষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত নানা আয়োজন করা হয় ৷ সব মিলিয়ে 150 কেজি আতপ চালের ভোগ রান্না করা হয় ৷ সঙ্গে থাকে 15 রকমের ফল ৷ মায়ের পুজোয় সর্বদা 60টি নারকেল নাড়ু নিবেদন করা হয় ৷ প্রতি বছর বাড়ির দুর্গাদালানেই প্রতিমা নির্মাণ করেন শিল্পী ৷
আগে এই পুজোয় প্রাণী বলি দেওয়া হত ৷ সপ্তমীর পুজো, সন্ধিপুজো এবং নবমী তিথিতে ছাগ বলি দেওয়া হত ৷ কিন্তু, বর্তমানে তাতে কিছু বদল আনা হয়েছে ৷ ছাগলের বদলে চালকুমড়ো, আখ, আদা, লেবু প্রভৃতি বলি দেওয়া হয় ৷ এছাড়া, সন্ধিপুজোর শুরুতেই 108টি প্রদীপ জ্বালানো হয় ৷ অষ্টমীতে বাড়িতে 'রচনা' তৈরি করা হয় ৷ যা আদতে রঙিন কাগজের তৈরি মালা ৷ সেই মালা দিয়েই আটচালা সাজানো হয় ৷ নবমীতে কুমারী পুজো এবং ধুনো পোড়ানোর রীতি পালন করা হয় ৷ এই ধুনো পোড়ার অনুষ্ঠানে বাড়ির মহিলারা সামিল হন ৷ তাঁদের হাতে এবং মাথায় মাটির পাত্রে ধুনো জ্বালানো হয় ৷ সব শেষে দশমীর সকলে অপরাজিতা পুজোর পর দর্পন বিসর্জনের মাধ্য়মে পুজোর পরিসমাপ্তি ঘটে ৷ দশমীর রাতেই বাড়ির পুরষ সদস্যরা নদীতে মাছ ধরেন ৷ তার ঠিক পরই দেবী প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয় ৷
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, একমাত্র ধুনো পোড়ার অংশটুকু বাদ দিলে পুজোর সমস্ত কাজ করেন পুরুষরা ৷ ফল কাটা, নৈবেদ্য সাজানো, পুজোর ভোগ রান্না, প্রতিমা ও বাড়ি সাজানো, ফল ও সবজি বলি, বাড়ির ভিয়েনে মিষ্টি তৈরি-সহ কোনও কাজই মহিলারা করেন না ৷