চন্দননগর, 15 অগাস্ট : কলকাতায় চাকরি করতে যাচ্ছেন ৷ এই একটা মিথ্যা কথা বলেছিলেন তিনি নিজের মাকে ৷ প্রথম বার ৷ তখন উত্তাল সময় ৷ স্বদেশী আন্দোলন চলছে ৷ ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশমাতাকে মুক্তি দিতে বদ্ধপরিকর একদল যুবক ৷ তাঁদেরই একজন ঠিক করলেন কলকাতায় যাবেন, দেশের কাজে ৷ কিন্তু বাড়িতে কি সত্যি বলা যায় ? প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে যে ৷ মা তো কলকাতায় যেতে দেবেন না তাহলে ৷ কিন্তু দেশমাতা যে আগে৷ তাই প্রথম বার মিথ্যা বলা, চাকরির ছুতো ৷ সেই সূত্র ধরেই দেশের কাজে বিশ্বাসঘাতককে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় সামিল হন চন্দননগরের সেই যুবক ৷ কানাইলাল দত্ত ৷ ব্রিটিশ চরকে হত্যার 'অপরাধে' ফাঁসির শাস্তি হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন যে কানাই ৷ সর্বতোষ ৷ কিন্তু চন্দননগরে জরাজীর্ণ, ভগ্নদশা কানাইয়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ৷ অভিযোগ কেন্দ্র বা রাজ্যের তরফে সেই অর্থে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এই দেশের জন্য আত্মত্যাগ করা মানুষটির স্মৃতিসম্বলিত বাড়িটির জন্য ৷
কানাইলালের স্মৃতি বলতে সরিষা পাড়ায় তাঁর মামাবাড়ির যে অংশে তাঁর পরিবার থাকতেন সেইটুকুই ৷ তবে তাও সংস্কারের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে । শুধু জন্মদিনে (জন্মাষ্টমী) সেই বাড়ির একটি ঘরে তাঁর আবক্ষ মূর্তিতে মালা দেওয়া হয় । রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকার কানাইলালের এই স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি কিছুই করেনি, অভিযোগ স্থানীয় এবং উত্তরসূরিদের৷ বাড়ির মধ্যে আগাছা ছেয়ে গেছে । কড়িবরগা থেকে চাঁই খসে পড়ছে । কানাইলালের কোনও সংগ্রহশালাও নেই চন্দননগরে । কানাইলাল যে চন্দননগর দুঁপ্লে কলেজে পড়াশোনা করেছে, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কে 1948 সালে বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের নামে চন্দননগর কানাইলাল বিদ্যামন্দির নামকরণ করা হয় । অভিযোগ, এই বিদ্যালয় তাঁর স্মৃতি থাকলেও আজ তা অবহেলায় পরে আছে । ফরাসি আমলের এই বিদ্যালয়েও হয়নি সংস্কার ।
2017 সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বিদ্যালয়কে হেরিটেজ কমিশনের অন্তর্গত করলেও তার এখনও কোন উন্নতি হয়নি । বড় বড় খিলান, গম্বুজ, কাঠের সিড়ি সাক্ষী ইতিহাসের ৷ কড়ি বর্গার ছাদ ফেটে জল পড়ছে । আগাছার শিকড় দেওয়াল ফাটিয়ে দিচ্ছে ৷ একথা উল্লেখ করে আলিপুর বোমা মামলার 'অভিযুক্ত' কানাইলালের মামার বাড়ি তরফে এক আত্মীয় শ্যামল দত্ত বলেন, '' স্মৃতিবিজড়িত এই ঘরে সারাই ও আলোর ব্যবস্থা আমি করি । সরকারি তরফে কোন উদ্যোগ নেই । স্বাধীনতা দিবসের দিনে ও 31 অগাস্টের জন্মদিন দিনে ফুল ও মালা দিয়ে সাজানো হয় ।এর বেশি কিছু হয় না ।''
চন্দননগর হেরিটেজের সম্পাদক কল্যাণ চক্রবর্তী বলেন, '' কানাইলাল দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন । কিন্তু দেশবাসী কানাইকে সেই সম্মান দিতে পারেননি । কানাইলালের জন্য একটা ছোট ডাকটিকিট প্রকাশ করার সদিচ্ছা দেখায়নি ভারত সরকার । '' কানাইয়ের যে বাড়িটা সরষেপাড়ায় আছে সে বাড়িটা অধিগ্রহণ করা বা বাড়িটাকে সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে তোলা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি ৷ তাঁর কথায়, ''ভারত সরকার বা রাজ্য সরকার অনেক বাড়ি অধিগ্রহণ করেছেন । তবে কানাইয়ের বাড়িটা আজও সেই জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে । তাই আজকে এই স্বাধীনতার প্রাক্কালে আমার মনে হয় কানাইকে নতুন করে মনে করা উচিত । সেই শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যে আমরা কানাইলালকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরব । সেটাই হবে বোধহয় এই স্বাধীনতা সংগ্রামের শপথ ।''
জেল হাসপাতালে দেশদ্রোহী নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীকে রাজনৈতিক হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল চন্দননগরের শ্রীশচন্দ্র ঘোষ । তিনিই খুনের 3 থেকে 4 দিন আগে পিস্তল জেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন । সেটা কার্যকর করতে প্রস্তুত ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু । নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর কাছে রাজসাক্ষী হওয়ার অভিনয় করেন তিনি ৷ এরপরই নরেন্দ্রকে হত্যার গোপন পরিকল্পনার অংশীদার হন কানাই লাল দত্ত । 1908 সালে 30 অগাস্ট সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে অসুখের ভান করে একই সঙ্গে হাসপাতালে ভরতি হন কানাই । গোপবনীয়তার কারণে কেউ জানতেন না দু'জনের কাছেই পিস্তল রয়েছে । 31 অগাস্ট 7টা নাগাদ নরেন গোঁসাই ( নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী) সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসেন হাসপাতালে । সেই সময় প্রথম সত্যেন্দ্রনাথ নরেন্দ্রকে গুলি করেন । সেখান থেকে পালাতে গিয়ে নর্দমায় পরে যেতেই গুলি করে হত্যা করে কানাই । প্রাণ হারায় বিশ্বাসঘাতক ৷ সাজা হিসেবে 10 নভেম্বর কানাইলালের ফাঁসি হয় । 13দিন পর ফাঁসি হয় সত্যেন্দ্রনাথেরও । দেশমাতৃকার এই সন্তানের বাড়িটি সংস্কারে প্রশাসনকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা থেকে চন্দননগরের হেরিটেজ সম্পাদক প্রত্যেকেই ৷