কৃষ্ণপুর (হুগলি), 17 জানুয়ারি: চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম শিষ্য রঘুনাথ দাস গোস্বামী । গ্রামে তাঁর প্রত্যাবর্তনের দিনটিকে স্মরণ করে উত্তরায়ন মেলার আয়োজন দেবানন্দপুরের কেষ্টপুরে ৷ কৃষ্ণপুর ঠাকুরবাড়ির সেবাইত অমর চক্রবর্তী জানালেন, এখানে আনুমানিক 1487-88 সালে জন্মগ্রহণ করেন মহাপ্রভুর শিষ্য ৷ মহাপ্রভুর টানে রঘুনাথ গোস্বামী একসময় বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ৷ তারপর পুরী ও বৃন্দাবন ঘুরে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন ৷ মহাপ্রভুর শিষ্যের বাড়ি ফিরে আসায় আনন্দের উৎসব শুরু হয় গ্রামজুড়ে ৷ মাছ খাওয়ানো হয় গ্রামবাসীদের ৷ সেই থেকে সূচনা রঘুনাথ দাস গোস্বামী স্মরণোৎসব মেলার ৷
প্রতি বছর ব্যান্ডেলের দেবানন্দপুরের কৃষ্ণপুরে মাঘ মাসের প্রথম দিনে শ্রীমদ্ রঘুনাথ দাস গোস্বামীর বাড়ির উত্তর দিকে এই মাছের মেলা বসে । তিনি 1 মাঘ বাড়ি ফিরেছিলেন ৷ এদিন থেকে সূর্যের উত্তরায়ন শুরু ৷ তাই এই মেলার আরেক নাম 'উত্তরায়ন মেলা' ৷ দূরদূরান্ত থেকে বহু মাছ ব্যবসায়ী এদিন এখানে আসেন । নদী, পুকুর ছাড়া বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছও দেখতে পাওয়া যায় । কী থাকে না এই মেলায় ? রুই, কাতলা, ইলিশ, ভেটকি থেকে শঙ্কর মাছ ৷ এমনকী যে সব মাছ সাধারণ মাছের বাজারে পাওয়া যায় না, তা মেলে এই বিশাল মাছের মেলায় ৷ চুনোপুটি থেকে 50-60 কিলো পর্যন্ত মাছ বিক্রি হয় এখানে ৷ 500 টাকা থেকে 1 হাজার 500 টাকা প্রতি কিলো দরে মাছ বিক্রি হয় ৷ হুগলির বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়া বর্ধমান, হাওড়া, নদিয়া, উত্তর 24 পরগনা, বাঁকুড়া থেকে মানুষ এই মেলায় আসেন মাছ কিনতে । অনেকে মাছ কিনে নিয়ে যান । আবার অনেকে পাশের আমবাগানে মাছ ভেজে পিকনিকের আয়োজন করেন ৷ এদিন এখান থেকে মাছ কিনলে তা প্রসাদ হয়ে যায়, জানালেন এক মাছ বিক্রেতা ৷
আরও পড়ুন: শাহীস্নানে সমুদ্র সৈকতে ভিড় জমিয়েছেন প্রায় 40 লক্ষ তীর্থযাত্রী
শ্রীমদ্ রঘুনাথ দাস গোস্বামী
কৃষ্ণপুর ঠাকুরবাড়ির সেবাইত অমর চক্রবর্তী জানালেন, মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের ছ'জন গোস্বামীর মধ্যে অন্যতম রঘুনাথ দাস গোস্বামী ৷ তাঁর বাবা এলাকার জমিদার গোবর্ধন মজুমদার, জেঠামশাইয়ের নাম হিরন্ময় মজুমদার ৷ হিরন্ময় মজুমদার সংসার করেননি ৷ কিন্তু গোবর্ধন মজুমদার সংসার করেন এবং তাঁরই সন্তান রঘুনাথ দাস গোস্বামী ৷ তিনি বংশের একমাত্র সন্তান ৷ তিনি বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা এখনও পূজিত হচ্ছে ৷ ছোট থেকে কৃষ্ণনামে বিভোর হয়ে থাকতেন ৷
রঘুনাথ দাস গোস্বামী সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যান ৷ কিন্তু মহাপ্রভু চৈতন্যের পারিষদ নিত্যানন্দ মহাপ্রভু তাঁকে পানিহাটি থেকে বাড়ি ফিরে যেতে নির্দেশ দেন । তখন তাঁর বয়স মাত্র 15 ৷ নিত্যানন্দ মহাপ্রভু তাঁর শিষ্যকে বলেন, "এখনও তোমার সময় হয়নি" ৷ দীর্ঘ 9 মাস পর বাড়ি ফেরেন রঘুনাথ দাস গোস্বামী । এরপর ফের বাড়ি থেকে তিনি পুরী যান, তারপর সেখান থেকে বৃন্দাবন ৷ বৃন্দাবন হয়ে কৃষ্ণপুরে বাড়ি ফিরে আসেন ৷
শ্রীমদ রঘুনাথ গোস্বামী বাড়ি ফিরে এলে গ্রামের মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান ৷ তাঁরা বাড়ির পিছনদিকের বাগানে মাছ রান্না করে খান ৷ আর বৈষ্ণবরা রঘুনাথ দাস গোস্বামীর কাছে আবদার করেন, তিনি সবসময় প্রভুর নামেই থাকেন ৷ তাঁরা বলেন, "আপনি আমাদের আম খাওয়ান ৷ আমরা আমের ঝোল খাব" ৷ ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণ দিকে একটি জোড়ো আমগাছ ছিল ৷ শোনা যায়, সেখানে অসময়ে অর্থাৎ মাঘ মাসে দুটি আম ফলেছিল ৷ আর পুকুরে জাল ফেলে জোড়া ইলিশ পাওয়া গিয়েছিল ৷ সে সব রান্না হয়েছিল বাড়ির বাগানে ৷ কিন্তু আমের ঝোল বাড়ির ভিতরে রান্ন করে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভক্তদের খাইয়েছিলেন রঘুনাথ দাস গোস্বামী ৷ সেই থেকে 516 বছর ধরে এই প্রাচীন উত্তরায়ন মেলা চলে আসছে হুগলির দেবানন্দপুরের কৃষ্ণপুরে ৷
আরও পড়ুন: পৌষ পার্বণে দেদার বিকোচ্ছে রেডিমেড পিঠে-পুলি