উত্তরপাড়া, 3 জুন: ওড়িশার রেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু মিছিলে দেখে আতঙ্কিত হুগলির দম্পতি । তাঁরাও ছিলেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসে । শুক্রবার ওই ট্রেনে উত্তরপাড়ার ধানকল গলির বাসিন্দা বনশ্রী ও দেবাশিস দত্ত চেন্নাই যাচ্ছিলেন । তাঁদের ছেলে নিলিমেশ দত্তর সঙ্গে দেখা করতে । শুক্রবার সাঁতরাগাছি থেকে দুপুর 3.32 মিনিটে ট্রেন ধরেন তাঁরা । করমণ্ডল এক্সপ্রেসের 20 নম্বর বগিতে ছিলেন ওই দম্পতি ।
বনশ্রী বলেন, "গতকালের সেই ঘটনা মনে করলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে । সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরলাম । চোখ বন্ধ করলেই ভেসে আসছে ভয়ঙ্কর সেই চিত্র । কত মানুষের চিৎকার আর আর্তনাদ । ট্রেনটা তখন ভালোই জোরে ছুটছিল । হঠাৎ একটা বিকট শব্দ, তারপর ট্রেনটা ভাইব্রেটের মতন কাঁপতে শুরু করে । আর এক দিকে হেলে যেতে শুরু করে । তখনও ট্রেনটার ভালোই গতি ছিল । আচমকা এই ঘটনা ঘটায় কেউ কিছু প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি । আমাদের বগিতে অনেকেই প্রথমে উঠে দাঁড়িয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করে ৷ কিন্তু এতটাই ট্রেনের ঝাকুনি ছিল যার ফলে কেও সিট থেকে উঠতে পারেনি । সকলের ব্যাগ পত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে শুরু করে ।"
আরও পড়ুন: বালাসোরে ট্রেন দুর্ঘটনায় পূর্ব মেদিনীপুরের কমপক্ষে তিনজনের মৃত্যু, আহত ও নিখোঁজ বহু
তিনি জানান, এরপর হঠাৎই একদিকে হেলে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে যায় । সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । এরপর বনশ্রীরা দেখেন মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে কিছু স্থানীয় বাসিন্দারা ছুটে আসছে । বুঝতে পারেন, ট্রেনটিতে বিশাল বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে । তখন পুরো এলাকা অন্ধকার, আর চারিদিকে ঘন জঙ্গল । স্থানীয় মানুষদের সাহায্যে দম্পতি ট্রেন থেকে নেমে আসেন । ট্রেনের সিঁড়ির দরজার হাঁতল কিছুই ছিল না । সবই ভেঙ্গে গুড়িয়ে গিয়েছে । রেললাইনের পাত উঠে খাড়া হয়ে যায় । কোনও মতে ট্রেন থেকে নেমে তাঁরা দেখেন চারিদিকে মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে । পাশের নয়ন জুলিতে পরে আছে ট্রেনের গোটা একটা বগি । মানুষের খালি চিৎকার শোনা যাচ্ছে ।
আরও পড়ুন: বাইরের রাজ্যে আর কোনওদিন কাজে যাব না, ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরে বললেন আশিস
দম্পতির কথা অনুযায়ী, প্রথমে স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধার কাজ শুরু করে । তারপর ঘটনাস্থলে পৌঁছয় রেল পুলিশের আধিকারিকরা । কে বেঁচে আছে আর কে মারা গিয়েছে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না । যাত্রীদের উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্স করে বালাসোর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । স্থানীয় বাসিন্দারা এগিয়ে এসে জল দেয় তাঁদের । তাঁরা স্বামী-স্ত্রী কোনও মতে তাঁদের সাহায্যে প্রায় এক কিলোমিটার রেললাইন ধরে হেঁটে হাই রোডের কাছে আসেন । ওখানে ওড়িশা সরকারের তরফে বাস দেওয়া হয় ৷ সেই বাসে করে কলকাতায় আসেন দত্ত দম্পতি । দেবাশিস দত্ত প্রাক্তন রেলকর্মী ।
তিনি বলেন, "পিছন দিক থেকে তিন নম্বর বগির সামনে থেকে কুড়ি নম্বর 2-এসি বগিতে ছিলাম । সাতটা নাগাদ দুর্ঘটনা ঘটে । তার আগে ট্রেন শেষ দাঁড়িয়েছিল বালাসোর স্টেশনে । দুর্ঘটনাস্থল বালাসোর থেকে 25 কিমি দূরে । হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ সমেত ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনের চাকা রেল ট্রাক থেকে নেমে কংক্রিট স্লিপারের উপর দিয়ে যেতে শুরু করে । ট্রেনের কামরার ভিতর তখন পরিত্রাহি চিৎকার ।"
আরও পড়ুন: মৃত্যু ছুঁয়ে হাওড়া ফিরে ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের যাত্রীরা
তিনি আরও বলেন, "পাওয়ার অফ হয়ে যায় । ট্রেন থামতেই স্ত্রীকে নিয়ে নামি । অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না । বুঝতে পারি খুব বড় মাপের দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে । আর কপাল জোরে তারা বেঁচে গেছি । দুর্ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা হেঁটে একটি রেল গেট দেখতে পান । সেখান থেকে ছোট রাস্তা ছেড়ে আরও এক কিমি হেঁটে হাইরোডে পৌঁছে একটা বাস পাই । সেই বাসে করে কলকাতা বাবুঘাটে ভোর পাঁচটায় তারপর উত্তরপাড়া।"