হুগলি, 29 জুন : লোকশিল্প সহ বাংলার সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য তৈরি হয় ব্রতচারী । শরীরচর্চার মধ্যে দিয়ে শিশু মনের বিকাশ ঘটনার লক্ষ্য ছিল ব্রতচারী’র সদস্যদের । যেখানে ছড়া, কবিতা, গান সহ বাংলার নানা ধরনের লোকনৃত্য যেমন ছৌ, রায়বেশে, লাঠি খেলা, ঢালি নৃত্য সহ একাধিক বাংলার সংস্কৃতিকে তুলে ধরার একটা অঙ্গন তৈরি হয়েছিল এককালে । গুরু সদয় দত্তের হাত ধরে তৈরি হয়েছিল ব্রতচারী । কিন্তু, কালের নিয়মে অনেকটাই এর অস্তিত্ব হারাতে বসেছে এই লোকশিল্পগুলি ।
রাজ্যে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার লোক শিল্পীদের নিয়ে লোক প্রসার তৈরি করে । রাজ্যে কয়েক লক্ষ শিল্পী এর আওয়াত রয়েছেন । সরকারি প্রকল্পের প্রচার ও নানা সচেতনতা মূলক প্রচার করেন এই ধরনের শিল্পীরা । কিন্তু, করোনার সংক্রমণ এই দেড় বছরে শিল্পীদের মুখের গ্রাস করে নিয়েছে । দু’বেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন শিল্পীরা । ফলে বাধ্য হয়েই মাসে এক হাজার টাকা ভাতা’র উপরেই নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে তাঁদের । সেটাও আবার মাঝে মধ্যে, নিয়মিত হয় না । দিশাহীন শিল্পীরা কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না । তার উপর করোনার তৃতীয় ঢেউ এলে, শিল্পীদের সঙ্গে বাংলার এই লোকশিল্প ধুয়ে মুছে যাওয়ার উপক্রম হবে । তবে, জেলা তথ্য সংস্কৃতি দফতর সূত্রে খবর, করোনা কিছুটা কমতেই আলোচনা চলছে সচেতনতার জন্য আবারও ব্যবহার করা যাবে এই সব শিল্পীদের । সব কিছুর মধ্যে লোকসংস্কৃতির আবারও প্রসার ঘটবে ৷
করোনা শুধু মানুষের জীবনই নেয়নি । সেই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাংলার সংস্কৃতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে । বাংলার লোকশিল্প নষ্ট হতে বসেছে । 1932 সালে লোকশিল্পের প্রসারের জন্য গুরু সদয় দত্তের হাত ধরে জন্ম হয়েছিল ব্রতচারীর । যেখানে সমাজ জীবনে শিশু মনের বিকাশ ও উপযুক্ত মানুষ হয়ে ওঠার ব্রত নেওয়ার চিন্তাভাবনা হয় । বাংলার বিভিন্ন অংশের লোকশিল্পকে এর মধ্যে তুলে ধরার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল । সেই চিন্তাভাবনা কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে করোনার জন্য । একদিকে যেমন স্কুলগুলি বন্ধ । সেই সঙ্গে এই ধরনের বাংলার শিল্প সংস্কৃতি সামাজিক দূরত্ব ও করোনা বিধির জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ।
মুখ্যমন্ত্রীর লোক প্রসার শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা কাজ হারিয়ে বাড়িতে বসে আছেন । যে সকল শিল্পীরা ব্রতচারী’র সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা এখন সমস্যার মধ্যে পড়েছেন । আবার প্রতি বছর যে লোকশিল্পীরা টাকা পেতেন, তাঁরাও এখন সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পাচ্ছেন না । রাজ্য সরকার লোকপ্রসার শিল্পীদের জন্য মাসে এক হাজার টাকা করে ভাতা দিলেও তাতে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না শিল্পীদের । তাই একদিকে যেমন লোকশিল্পরা হারিয়ে যেতে বসেছেন, তেমনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাংলার লোকশিল্পও ।
হুগলি জেলায় কয়েক হাজার লোকশিল্পী আছেন । চন্দননগরের ব্রতচারীর সঙ্গে যুক্ত আছেন বেশ কয়েকজন রায়বেশে শিল্পী । হুগলি জেলায় রায়বেশের 62 জন শিল্পী আছেন । রায়বেশে লোকনৃত্যে রয়েছে লাঠি খেলা, ঠালি নৃত্য, রণ-পা সহ নানা নৃত্য ও নানান শারীরিক কসরত ৷ ধুতি ও কাপড় টান করে পড়ে লাল শাসলু দিয়ে যোদ্ধার বেশে নৃত্য ও বিভিন্ন রকম কসরতের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরা হয় রায়বেশে লোকনৃত্য । ঢাক, কাঁসরস ধামসা-সহ নানা বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে এই লোকশিল্পকে তুলে ধরা হয় । রাজ্য সরকারের লোক প্রসার শিল্পী আওতায় এই সব শিল্পীদের রোজগার হচ্ছিল ৷ কিন্তু, করোনার জেরে এখন পুরোপুরি তা বন্ধ হয়ে গেছে । তার জেরেই সমস্যা পড়েছেন লোকশিল্পীরা ।
চন্দননগর ব্রতচারীর সঞ্চালক সুদীপ দাস জানিয়েছেন, ‘‘করোনা পরিস্থিতির মধ্যে লোকশিল্প পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । লোকশিল্পের অঙ্গ হিসেবে গড়ে উঠেছিল ছিল ব্রতচারী । সেই অনুশীলনও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । বর্তমান প্রজন্মকেও আনা যাচ্ছে না । এর মধ্যে যাঁরা এই ব্রতচারী সঙ্গে ছিলেন, তাঁদেরও আমরা হারাতে বসেছি এই করোনার দাপটে । বাংলা সরকার নতুন করে লোকপ্রসার এর মাধ্যমে লোকসংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল । আমরা বাংলার সংস্কৃতিকে বাঁচানো জন্য চেষ্টা করতাম । সেই সঙ্গে জীবিকা অর্জন করছিলাম ৷ সেটাও এখন হচ্ছে না । প্রতি মাসে 15টি লোকশিল্পের অনুষ্ঠান করছিলাম । কিন্তু এখন তা সম্পূর্ণ বন্ধ । সেই কারণেই এখানকার শিল্পীরা অন্য জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা করছে । আগামী দিনে পরিস্থিতি কী হবে ? তাও বুঝতে পাচ্ছি না আমরা । কিন্তু আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি যা করোনার দাপটে নষ্ট হতে বসেছে, তাকে আমাদেরই বাঁচাতে হবে । সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে চলেছি ৷’’