দার্জিলিং, 23 জানুয়ারি: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ৷ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমন এক নাম যাঁকে নিয়ে ব্রিটিশ আমলে তো বটেই, এমনকী দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও আন্দোলিত হয়েছে জাতীয় রাজনীতি ৷ নেতাজি এখন জীবিত নাকি তিনি প্রয়াত, মৃত্যু হলে কবে কোথায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে এই নিয়ে বিতর্ক ও অনুসন্ধান আজও অব্যাহত ৷ দেশের স্বাধীনতার 75 বছর পরেও ভারতবাসীর মননে, চিন্তায়, সংগ্রামের ইতিহাসে ও রাজনীতিতে আজও প্রাসঙ্গিক বাংলা মায়ের এই বীর সন্তান ৷
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন নেতাজি । তাঁর "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব" বক্তব্য সেসময়ে উজ্জীবিত করেছিল দেশের যুব সমাজকে । কখনও ছদ্মবেশে আবার কখনও বা রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ভারতকে স্বাধীন করতে দেশ-বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি । শত্রুর শত্রুকে বন্ধু করে নেওয়া যুদ্ধের অন্যতম প্রাচীন নিয়ম। সেটাই করেছিলেন নেতাজি । ব্রিটিশকে দেশ ছাড়া করতে সাহায্য আদায় করেছিলেন খোদ হিটলারের কাছ থেকেও। সবমিলিয়ে ইংরেজ শাসকদের কাছে ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র ৷ স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি যাতে নেতৃত্ব দিতে না-পারেন সেজন্য তাঁকে একাধিকবার বন্দি থাকতে হয়েছিল ব্রিটিশদের হাতে ।
একবার সুভাষচন্দ্র বসুকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল দার্জিলিংয়ের দুর্গম পাহাড়ে । এই ঘটনা আজও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অধ্যায়ে এক অনবদ্য ইতিহাস ৷ জায়গাটা দার্জিলিংয়ের কার্শিয়াং ব্লকের গিদ্দা পাহাড় । 1922 সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা শরৎচন্দ্র বসু গিদ্দা পাহাড়ে ছুটি কাটানোর জন্য রাউলি লেসেলেস ওয়ার্ডের থেকে একটি শৈল নিবাস কিনেছিলেন । বছরে অন্তত দু'বার সপরিবারে সেখানে ছুটি কাটাতে যেতেন শরৎচন্দ্র বোস । সঙ্গে থাকতেন ভাই সুভাষও (Netaji Museum in Darjeeling) ৷
আরও পড়ুন: আজকের দিনেই এসেছিলেন নেতাজি, স্মৃতিমেদুর পুরুলিয়ার চট্টোপাধ্যায় পরিবার
1925 থেকে 1935 সালে পর্যন্ত সেই বাড়িতে আসা যাওয়া লেগেছিল বসু পরিবারের । এরই মাঝে সুভাষচন্দ্র বসু সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন । কিন্তু নেতাজি যাতে কোনওভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করতে না পারেন তার জন্য 1936 সালে তাঁকে প্রথমে কলকাতার বাসভবনে নজরবন্দি করে রাখে ব্রিটিশরা । এরপর নেতাজির অসুস্থতার জন্য শরৎচন্দ্র বোসের গিদ্দা পাহাড়ের বাড়িতে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় । 1936 সালের জুলাই মাসে গিদ্দা পাহাড়ে 6 মাসের জন্য নজরবন্দি রাখা হয়েছিল তাঁকে ।
তবে নজরবন্দি থাকলেও নেতাজির স্বাধীনতা সংগ্রামের দৃঢ় পরিকল্পনাকে কোনওভাবেই দমাতে পারেনি ব্রিটিশরা । চব্বিশ ঘণ্টা কড়া ব্রিটিশ পাহারার মধ্যে রাখা হয়েছিল তাঁকে । তবে তার মধ্যেই ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা চালিয়ে গিয়েছিলেন নেতাজি । এই বাড়িতে বেশিরভাগ সময় বই পড়েই কাটাতেন তিনি । তাঁর সঙ্গে কথা বলার মধ্যে একমাত্র ছিলেন তাঁর ছায়াসঙ্গী কালু সিং লামা । একমাত্র ওই ব্যক্তিই নেতাজির সঙ্গে দেখা করতে পারতেন । তাঁর উপরই ছিল নেতাজির খাওয়া-দাওয়া ও দেখাশোনার দায়িত্ব ।
এই কালু সিং লামার নেতাজির পরিবারের সঙ্গে বেশ সক্ষতা ছিল । এমনকী তাঁর কলকাতার বাড়িতেও আনাগোনা ছিল । ওই ছয় মাসে গিদ্দা পাহাড় থেকে কম করে 26টি চিঠি লিখেছিলেন তিনি । যার মধ্যে 11টি তিনি লিখেছিলেন তার প্রেমিকা জার্মানির এমিলি শেঙ্কলকে । পাশাপাশি এমিলির থেকেও 10টি চিঠি এসেছিল তাঁর জন্য । এছাড়াও সেসময় পাহাড় থেকেই জওহরলাল নেহেরু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও চিঠি লিখেছিলেন নেতাজি।
তবে এমিলির সঙ্গে নেতাজির চিঠি চালাচালির বিষয়টি পুলিশ জানত ৷ নেতাজির পাঠানো চিঠিগুলি সরাসরি জার্মানিতে এমিলির কাছে যেত না ৷ ডিএম-এসপির হাত ঘুরে, সেন্সরড হয়ে পুলিশের ঝারাই-বাছাই এর পর সেই চিঠি এমিলির কাছে যেত ৷ এমিলির পাঠানো চিঠিগুলিও একইভাবে সেন্সরড করত ব্রিটিশ পুলিশ ৷ তবে নেতাজির গোপনে চিঠি পাঠানোর বিষয়টি কোনওদিন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ব্রিটিশরা । কালু সিং লামার মাধ্যমে একাধিক চিঠি তিনি পাঠিয়েছিলেন কলকাতায় নিজের সংগ্রামী বন্ধুদের কাছে । চিঠি পাঠাতে নানা উপায়ও বের করেছিলেন সুভাষ ।
কালু সিং লামা খাবার দিতে গেলে বেঁচে যাওয়া পাউরুটির ভিতরে লুকিয়ে চিঠি পাঠাতেন তিনি । চিঠি লুকিয়ে নিয়ে যেতে আবার যাতে ব্রিটিশ সৈনিকরা কোনওভাবে ধরতে না পারে সেজন্য কালু সিং লামার জন্য আলাদা জুতো তৈরি করিয়েছিলেন নেতাজি । জুতোর সোলে নেতাজির লেখা সেই চিঠি লুকিয়ে কলকাতায় নিয়ে যেতেন কালু সিং । এছাড়াও পায়জামার কোমরে গোপন চেম্বার বা কখনও পাঞ্জাবির কলারেও নেতাজির লেখা চিঠি নিয়ে যাওয়া হত । আর চিঠি নিয়ে কালু সিং লামার সঙ্গে মুখে কোনও কথা হতো না নেতাজির । সবটাই চলত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারায় । নেতাজি 1945 সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও গিদ্দা পাহাড়ের বাড়িতে বোস পরিবারের আসা-যাওয়া ছিল । 1945 সালে শেষবারের মতো এই বাড়িতে এসেছিলেন শরৎচন্দ্র বোস এবং তাঁর পরিবার (Netaji museum at Giddapahar in Kurseong) ।
তারপর থেকে টানা কয়েক দশক সেই বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল । 1996 সালে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতর ওই বাড়িটি অধিগ্রহণ করে এবং সেটিকে সংস্কার এবং মেরামত করে নেতাজি ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের হাতে হস্তান্তর করে দেয় । 2001 সালের 3 নভেম্বর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ওই মিউজিয়ামের সূচনা করেন । বহু বছর পর্যন্ত নেতাজির এখানে নজরবন্দি থেকে চিঠি লেখার ঘটনা সামনে আসেনি । 2004 সালে কালু সিং লামার মেয়ে প্রয়াত মোতিমায়া লামা বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন । এরপরই কলকাতার বোস পরিবারের বাসভবন থেকে উদ্ধার হয় নেতাজির লেখা একাধিক চিঠি ।
তবে দার্জিলিং নেতাজির খুব প্রিয় জায়গা ছিল । সুভাষচন্দ্রের কথায়, "আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন হবে যখন আমি স্বাধীন হব এবং আরও সুখী হব দার্জিলিং গেলে ।"এই প্রসঙ্গে নেতাজি মিউজিয়ামের আধিকারিক গণেশ প্রধান বলেন,"নেতাজি এখানে নজরবন্দি থাকলেও চুপ করে বসেছিলেন না । তিনি নানাভাবে স্বাধীনতার পরিকল্পনা করছিলেন । খুব গোপনে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে চিঠি পাঠাতেন তিনি ।" 2017 সালে প্রয়াত হন কালু সিং লামার মেয়ে মোতিমায়া লেপচা । তাঁর পুত্রবধূ হিঙ্গা লেপচা বলেন,"আমার শ্বাশুড়ি নেতাজির সঙ্গে খেলতেন, সময় কাটাতেন । তখন তাঁর বয়স 10 বছর । তিনিই আমাদের বলেছিলেন নেতাজি কী করতেন, কীভাবে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ।" ইতিহাসের অধ্যাপক তথা শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যক্ষ সুজিত কুমার ঘোষ বলেন,"গিদ্দা পাহাড়ে নেতাজির কাটানো সময়কাল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ।"