তপন, 9 জুলাই : রাজ্য সরকারের আর্থিক অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলে নীল-সাদার জায়গায় গেরুয়া ? কভি নেহি । কাজ প্রায় শেষ হলেও ভাঙতে হবে সেসব । কার্যত সেই ফতোয়াই জারি করেছে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব । এদিকে স্থানীয়দের একাংশ তৃণমূল নেতৃত্বের এমন ফতোয়ার বিরোধিতায় সরব । গোটা ঘটনায় বিপাকে পড়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ । এই পরিস্থিতিতে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমাধানের রাস্তা খুঁজছেন প্রধান শিক্ষক ।
ঘটনাটি দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার তপন থানার ভাইওর জালালিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের । দীর্ঘদিন ওই স্কুলে কোনও সাংস্কৃতিক মঞ্চ ছিল না । বছর দুয়েক আগে স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুল প্রাঙ্গনে তেমনই একটি মঞ্চ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় । সেই মতো পরিকল্পনাও করা হয় । শুরু হয় মঞ্চ নির্মাণের কাজ । প্রাথমিক কাজ শেষে মঞ্চের বাইরের অংশে লাগানো হয় টাইলস । সেই টাইলসের রং নিয়েই দেখা দেয় বিপত্তি । টাইলসগুলি কমলা রংয়ের। গেরুয়ার কাছাকাছি রং । স্কুলের সাংস্কৃতিক মঞ্চের টাইলসের রং গেরুয়ার কাছাকাছি হওয়ায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব । সরকারি আর্থিক অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলে কেন নীল-সাদার পরিবর্তে গেরুয়া টাইলস? এই প্রশ্নে সরব হয়ে ওঠে শাসক শিবির । জানা গেছে, এনিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে এলাকার তৃণমূল নেতৃত্বের নির্দেশ আসে, গেরুয়া টাইলস ভেঙে নীল-সাদা টাইলস লাগাতে হবে । এদিকে গ্রামবাসীদের একাংশের বক্তব্য, অনেক খরচ করে টাইলসগুলি লাগানো হয়েছে । ফের তা ভেঙে ফেলে অতিরিক্ত খরচের প্রয়োজন কীসের? তারা স্কুল কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়, পুরোনো টাইলস বহাল রাখতে হবে মঞ্চে । এইনিয়েই এখন প্রবল বিপাকে পড়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ ।
তপন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও এলাকার তৃণমূল নেতা রাজু দাসের সাফ কথা, "ভাইওর জালালিয়া স্কুলটি আমার বাড়ির পাশে । অনেক পুরোনো স্কুল । সেখানকার স্থানীয় ছেলেরা আমাকে জানিয়েছে, স্কুলের ভিতর একটি মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছে । সেই মঞ্চে গেরুয়া রংয়ের টাইলস লাগানো হয়েছে । এই খবর জেনে প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যাই । স্কুলের শিক্ষকরা বিষয়টি আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি । শুধু আমাকে নয়, বিষয়টি তাঁরা BDO-কে জানাননি । আমি সেই নির্মীয়মাণ মঞ্চের ছবিগুলি দেখেছি । সেই ছবি আমি BDO ও SI-কে পাঠিয়েছি । আমাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে কিছু শিক্ষক এই কাজ করেছেন । আমি স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলেছি, রাজ্য সরকারের নীল-সাদা রং সেই মঞ্চে ব্যবহার করতে হবে । শিক্ষকরা কথা দিয়েছেন, খুব তাড়াতাড়ি তাঁরা টাইলস পালটে ফেলবেন । এই ঘটনায় এলাকার মানুষের মধ্যে আপত্তি রয়েছে । সেটা স্বাভাবিক । কারণ, শিক্ষকরা যে ঘটনা ঘটিয়েছেন তাতে আপত্তি ওঠা স্বাভাবিক । রাজ্য সরকারের স্কুলে গেরুয়া রং দেখে আমি স্তম্ভিত ।"
এদিকে স্থানীয় নবাবনগর গ্রামের বাসিন্দা, স্কুলের প্রাক্তনী দেবুল রায় এপ্রসঙ্গে বলেন, "এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের একটি দাবি ছিল, স্কুলে একটি স্থায়ি সাংস্কৃতিক মঞ্চ হোক । স্থানীয়দের দাবি মেনে শিক্ষকরা সেই কাজ শুরুও করে দিয়েছেন । এখন এই মঞ্চকে কেন্দ্র করে কিছু সুবিধাবাদী লোকজন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মঞ্চের রং নিয়ে মেরুকরণের রাজনীতি করার চেষ্টা করছে । তাঁরা বলছেন, এই রং নাকি হিন্দুত্বের । শিক্ষকরা না কি BJP-র মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে মঞ্চের টাইলসের এই রং ঠিক করেছেন । আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রংয়ের পোশাক পরি । কারণ, পৃথিবীর প্রতিটি রং সুন্দর । এখানে কিছু রাজনৈতিক পদাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ফতেয়া দিচ্ছেন, যে কোনও উপায়ে নির্মীয়মাণ সেই মঞ্চের টাইলস ভেঙে ফেলতে হবে । সেখানে রাজ্য সরকারের রং ব্যবহার করতে হবে । তাঁরা রাজ্য সরকারের যে তহবিলের টাকায় পুরোনো টাইলস ভেঙে নতুন লাগাতে বলছেন, সেই টাকা অন্য কাজে ব্যবহার করলে বেশি ভালো হয় । তবে যদি কেউ এই মঞ্চ ভাঙতে যায় কিংবা ভাঙার প্ররোচনা দেয়, তবে আমরাও ছেড়ে কথা বলব না । প্রয়োজনে আমরাও এনিয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হব । সরকারি অর্থের নয়ছয় সাধারণ মানুষই রুখে দেবে ।"
গোটা ঘটনা নিয়ে প্রবল সমস্যায় পড়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ । প্রধান শিক্ষক মানবেশ লাহাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "এনিয়ে আমার কাছে কেউ সেভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেনি । টাইলসগুলি মূলত কমলা রংয়ের এটা ঠিক গেরুয়া নয় । কিছু লোক এই বিষয়টিতে রাজনৈতিক রং চড়াতে চাইছে । আমাদের স্কুলের রং নীল-সাদা রয়েছে । কারণ, সরকারি নির্দেশ আমাদের মানতেই হবে । টাইলসের রং বছর দেড়েক আগেই ঠিক করা হয়েছিল । যে শিক্ষকরা এই কাজের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁদের একজন বলরামপুর রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে জড়িত । তেমনই কোনও জায়গা থেকে হয়তো তিনি এই রংটি পছন্দ করেছেন । অনেক আগেই তিনি এই রংয়ের বিষয় শিক্ষকদের জানিয়েছিলেন । তখন কেউ কোনও আপত্তি করেননি । কাজ যখন চলছিল, আপত্তি আসেনি তখনও । আপত্তি থাকলে তখনই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম । এই স্কুলে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের সন্তানরা পড়াশোনা করে । সেখানে এমন একটি বিষয় নিয়ে রাজনীতি না আসাই ভালো । এই মঞ্চ নির্মাণে সম্পূর্ণ অনুদানের টাকার উপর আমাদের ভরসা করতে হচ্ছে । যাঁরা টাইলসের রং নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আমরা বার বার আলোচনায় বসছি । আশা করছি, গোটা বিষয়টি তাঁদের বোঝাতে পারব । আমাদের সবাইকে নিয়েই চলতে হবে ।"