কুশমণ্ডি, 12 সেপ্টেম্বর : লকডাউনে মুখ থুবড়ে পড়েছে কুশমণ্ডির মুখোশ শিল্প । বাজার বন্ধের ফলে চাহিদা নেই, তাই বায়নাও নেই ৷ গত দেড় বছর ধরেই চলছে এমন অবস্থা ৷ কুশমণ্ডির মহিষবাথানের শিল্পীরা হস্তশিল্প ছেড়ে বাধ্য হয়েই কৃষিকাজে যুক্ত হচ্ছেন ৷ অনেকে আবার ভিনরাজ্যে পাড়িও দিচ্ছেন কাজের সন্ধানে ৷ বিশ্ববাজারে প্রসিদ্ধ কুশমণ্ডির মুখোশ ৷ সেই শিল্প থেকে এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অল্পবয়সীরা ৷ তাই সেই ধারা বজায় রাখতে এগিয়ে এসেছেন মহিলারা ৷ মুখোশ শিল্পের কাজ শিখতে শুরু করছেন অনেকেই ৷ তাঁদের উৎসাহ দিতে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন মেলা শুরু করা হবে ৷ সেখানে মুখোশ শিল্পীদের জন্যও স্টলের ব্যবস্থা থাকবে ।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রাচীন শিল্পকলা কুশমণ্ডির মুখোশ শিল্প । জেলার রাজবংশীদের দেশিয়া ও পোলিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্বেষমূলক আচরণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এই শিল্পকলা । তাঁরা অশুভ শক্তি তাড়াতে এই মুখোশ এবং সেগুলির উপাসনা শুরু করেন ৷ পরে সেখান থেকেই তৈরি গোমিরা নৃত্যকলা ৷ মুখা নাচের চল তখন থেকেই ৷ গোমিরা নৃত্যে দু'টি চরিত্র 'বুড়া-বুড়ি', যা শিব ও পার্বতী রূপে মানা হয় । এছাড়াও গোমিরা নৃত্যশিল্পীদের জন্য নানা ধরনের কাঠের মুখোশ তৈরি করা হয় ৷ রাজবংশী সম্প্রদায়ের কাছে এই কাঠের মুখোশগুলি উপাসনা এবং নিষ্ঠার বস্তু ।
মহিষবাথান, ঊষাহরণ, বেরাইল, দেহাবন্দের মতো বিভিন্ন গ্রামে ঐতিহ্যবাহী এই মুখোশ তৈরি করা হত । একটি কাঠের টুকরোকে ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে কেটে শিল্পীরা তৈরি করেন মুখোশ । বাঁশ কেটেও তৈরি করা হয় নানা মুখোশ এবং কারুকার্য । ঐতিহ্যবাহী প্রথা ধরে রাখার পাশাপাশি হস্তশিল্পকে তুলে ধরতে তৈরি হয় মহিষবাথান গ্রামীণ হস্তশিল্প সমবায় সমিতি । প্রথমে মাত্র 27 জন শিল্পী নিয়ে পথা চলা শুরু হয়েছিল কুশমণ্ডির মহিষবাথানের । হস্তশিল্পকে তাঁরা জীবিকা হিসাবে বেছে নেন । পরে সেই সংখ্যা 500 ছাড়ায় । শুধু এই জেলা বা এরাজ্য বা এদেশ নয়, মহিষবাথানের মুখোশ শিল্পের খ্যাতি পৌঁছেছে বিদেশেও ৷ একটা সময় এই পেশার সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগ মানুষ পেট চালানোর জন্য ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে চলে যেতেন । বিশ্বের বাজারে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করার পর আবার নতুন প্রজন্ম এই শিল্পমুখী হয়েছে ।
সম্প্রতি দক্ষিণ দিনাজপুরের এই শিল্পের উন্নতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একগুচ্ছ পরিকল্পনা নেওয়া হয় । শিল্পীদের সরকারি পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে । 2013 সাল থেকে শিল্পকলাগুলি জনসমক্ষে তুলে ধরতে রাজ্য সরকার ও বাংলা নাটক ডট কম একত্রে মুখ মেলা শুরু করে । এছাড়াও বাংলা নাটক ডট কম এই মুখোশ নিয়ে যায় কলকাতা, দিল্লি, চেন্নাইয়ের বিভিন্ন মেলায় । দক্ষিণ দিনাজপুরের মুখোশ শিল্পী শঙ্কর দাস তাঁর শিল্পকলা নিয়ে ছ'বছর আগে পাড়ি দিয়েছিলেন লন্ডনে । কলেবর বেড়েছে মহিষবাথান গ্রামীণ হস্তশিল্প সমবায় সমিতিরও ৷ পোশাক সমিতিতে তৈরি হয়েছে তিনতলা ভবন । পর্যটকদের থাকার জন্য ঘর-সহ শিল্পকলা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া শিল্পকলা বাঁচানোর পর করোনা পরিস্থিতিতে ফের সমস্যায় পড়েছেন মহিষবাথানের মুখা শিল্পীরা । বছরভর নানা মেলা ও বাজার বন্ধ থাকায় বিক্রি হচ্ছে না মুখোশ । নতুন করে বায়না বা অর্ডার দিচ্ছেন না ক্রেতারা । ফলে গত দেড় বছর ধরে এক প্রকার কাজ বন্ধ ৷ লকডাউনে দীর্ঘদিন বন্ধ-ও ছিল মহিষবাথান গ্রামীণ হস্তশিল্প সমবায় সমিতি । গত 2 জুলাই থেকে ফের কাজ শুরু হলেও শিল্পীর সংখ্যা হাতেগোনা । অর্ডার না থাকায় ঢিমেতালে চলছে কাজ ।
মুখোশ শিল্পী শঙ্কর দাস বলেন, "এখানে কাজ শিখেছি । করোনা পরিস্থিতির জন্য কাজ প্রায় বন্ধ । অর্ডার পেলে কাজ করছি, মেলা আর করা হচ্ছে না । সংসার চালাতে এই কাজে অর্থ উপার্জন কম হওয়ায় কৃষিকাজে হাত লাগাচ্ছি ।" আর এক শিল্পী তুলি দাস বলেন, "আমরা বাড়ির মহিলারা বেশ কিছুদিন ধরেই এই বাঁশের কাজ শিখছি । স্বামীদের রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্যায় পড়তে হয়েছে ৷ সংসারের হাল ধরতে আমরাও এই বাঁশের কাজ শিখছি । কাজ শিখতে বেশ ভাল লাগছে ৷"
শিল্পী পরেশচন্দ্র সরকার বলেন, "দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ নিয়ে গিয়েছি ৷ কিন্তু বর্তমানে লকডাউন থাকায় সব মেলা বন্ধ । সরকারের তরফ থেকে একসময় সায়েন্স সিটিতে এবং পরে বিশ্ববাংলা হাটে শিল্পকলা প্রদর্শনী করা ও বিক্রি করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । 800 টাকা থেকে শুরু করে 8000 টাকায় বিভিন্ন মাপের মুখোশ বিক্রি করেছি । বাংলা নাটক ডট কমের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজের অর্ডার আসত ৷ কিন্তু বর্তমানে লকডাউন পরিস্থিতিতে সব বন্ধ । ফলে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা কাজে এসেও ফিরে যাচ্ছেন । সমস্যায় রয়েছি মুখোশ শিল্পীরা ।"
গঙ্গারামপুরের মহকুমাশাসক মানবেন্দ্র দেবনাথ বলেন, "মুখোশ শিল্পীরা সমস্যায় পড়েছেন ৷ আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন মেলা শুরু করব । সেখানে মুখ শিল্পীদের স্টলের ব্যবস্থা থাকবে ।"
আরও পড়ুন : Afghanistan Crisis : আফগানিস্তানে রফতানি বন্ধ, ইতিমধ্যেই 20 কোটি টাকার ক্ষতি উত্তরবঙ্গের চা শিল্পে