সুন্দরবন, 19 মে : ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে গেছে আয়লা । বুলবুলের দাপটে ভেঙেছে একাধিক নদীর বাঁধ (মাতলা, বিদ্যাধরী, হোগল) । এবার আমফানের পূর্বাভাসে সিঁদুরে মেঘ দেখছে সুন্দরবনবাসী । বুলবুলের সময় মণি, ঠাকুরাণ নদীর বাঁধ ভেঙে একাধিক গ্রামে প্রায় আড়াই ফুট উপরে রাস্তায় জল উঠেছিল । তারপর থেকে প্রশাসনের তরফে কংক্রিটের বাঁধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বারবার। কিন্তু, আজও সেকাজ হয়নি। আমফানের পূর্বাভাসে তাই পুরানো আতঙ্কের কথা শোনালেন রায়দিঘি দমকল সীমানা ঘাটের বাসিন্দারা ।
ছোটো ছোটো দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন । সব দ্বীপেই কম-বেশি মানুষের বসবাস । নদীমাতৃক এলাকা হওয়ায় এই সমস্ত দ্বীপের মানুষ মাছ-কাঁকড়া ধরে বাঘ ও কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকেন । কিন্তু, কোনও বড় সাইক্লোন বা বর্ষা এলে আতঙ্কে থাকেন তাঁরা । কারণ, ভগ্নপ্রায় নদীবাঁধ । মাতলা, বিদ্যাধরী, হোগল, মণি, ঠাকুরাণ কত না নদী। কিন্তু, একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এইসব নদীর অধিকাংশ বাঁধই ভেঙে গেছে। ফলে, আতঙ্ক রয়েই গেছে।
2009 সালের আয়লার ক্ষত এখনও দগদগে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের মনে। সেই সময় মণি ও ঠাকুরাণসহ এলাকার প্রায় সব নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে গেছিল গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, বাসন্তী, কুলতলি, নামখানা, সাগরসহ বিভিন্ন ব্লকের বহু গ্রামে। মৃত্যু হয়েছিল বহু মানুষের । অভিযোগ, তারপর থেকে প্রশাসনের তরফে ওইসব নদীতে কংক্রিটের বাঁধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বারবার। কিন্তু, আজও তা কার্যকর হয়নি । সুন্দরবনের গোসাবা থেকে শুরু করে কাকদ্বীপ বিস্তীর্ণ এলাকায় বহু নদীবাঁধের এখনও বেহাল অবস্থা । বুলবুলের সময়ও একাধিক নদীর বাঁধ ভেঙে যায় । বুলবুলের পর এইবার আমফান । সেই ঝড় আসার আগে তাই ভয়ে সুন্দরবনবাসী ।
প্রাণ থাকবে কি না ? আশঙ্কায় রায়দিঘির বাসিন্দ ইয়াসিন গাজ়ি । বলেন, “আয়লার ঝড়ে মাটির ঘরবাড়ি পড়ে গেছিল । গোটা এলাকা জলমগ্ন হয়ে যায় । বুলবুলে ঘরবাড়ি পড়েছেই, নদীও ভয়ঙ্কর হয়েছিল । রাস্তার উপর জল উঠে গেছিল । অনেক মৎসজীবী মারা যান । আমরা চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছিলাম । আমফান আসছে । আরও ভয়ঙ্কর হবে শুনছি । মানুষকে নিরাপদ জায়গায় রাখলে তাঁরা প্রাণে বাঁচবেন । কিন্তু ঘরবাড়ির কী হবে জানি না । সরকারের কাছে আবেদন, আমাদের নদীবাঁধ ঠিক করে দিক । নয়ত বার বার এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে আমরা মোকাবিলা করব কীভাবে ? জানি না এবার প্রাণ থাকবে কি না ।”
নদীতে মাছ-কাঁকড়া ধরে দিনযাপন করেন একই এলাকার মৎসজীবী পঙ্কজ ঘড়ুই । গরিব মানুষ। তাই যে কোনও প্রকারে বাঁচতে হবে বলে আক্ষেপ করেন তিনি । বললেন, “আমরা গরিব মানুষ । যাওয়ার কোথাও জায়গা নেই । জাল সব ছিঁড়ে গেছে । লকডাউনের জন্য কিনতে পারছি না । কাজ বন্ধ । সরকার থেকে যা দেয় তা-ই খাই । এবার ঝড় হবে বলছে । আগেও দেখেছি, আবার হয়ত দুর্যোগের দিন আসছে । কীভাবে বাঁচব জানি না ।”
রায়দিঘির কয়েকজন জানান, তাঁদের যোগাযোগের উপায় সীমানার জেটিঘাট । ইতিমধ্যে নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে সেই জেটি । বর্তমানে জেটিকে বাঁশ দিয়ে মূল স্থলভাগের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে । জেটির সঙ্গে সংলগ্ন প্রায় তিন কিলোমিটার নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে । বাঁধের প্রায় পুরোটাই ভেঙে নদীগর্ভে চলে গেছে । বাকি আর সামান্য অংশ ।
এই পরিস্থিতিতে এইসব এলাকার অধিকাংশ গ্রামের বাসিন্দা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ঝড় এলে নড়বড়ে নদীবাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢুকে যাবে । চোখের সামনে আয়লা, বুলবুলে অনেক ক্ষতি দেখেছেন তাঁরা । তাই এখন দুশ্চিন্তায় ও ভয়ে দিন কাটছে । লকডাউনে রোজগার প্রায় বন্ধ । প্রশাসনের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে ওই মানুষগুলো । অস্তিত্ব সংকটে দিন কাটছে। আরও একবার সিঁদুরে মেঘ দেখছে সুন্দরবন ।