কলকাতা, 17 জুলাই : ব্রেন ডেথ ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরও রোগীর চিকিৎসার খরচ হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন রকমের বিল পেশ করা হয়েছে হাসপাতাল থেকে । রোগীর পরিজনদের তরফে এমনই অভিযোগ উঠল মিন্টো পার্কের কাছে অবস্থিত বেসরকারি একটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে । অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ । তবে, পরিজনরা জানিয়েছেন, ব্রেন ডেথ ঘোষণা এবং অঙ্গদানের ক্ষেত্রে যাতে আগামী দিনে অন্যদের এই ধরনের কোনও সমস্যায় পড়তে না হয়, তার জন্য এই বিলের বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্থানে তাঁরা অভিযোগ জানাবেন। এক্ষেত্রে, ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশনে তাঁরা অভিযোগ দায়ের করবেন ।
সোমবার সন্ধ্যার পরে মিন্টো পার্কের কাছে অবস্থিত বেসরকারি ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা পূর্ব বর্ধমানের মেমারির বাসিন্দা চিন্ময় ঘোষ (৩৬)-এর ব্রেন ডেথ ঘোষণা করেন । 10 জুলাই থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল চিন্ময় ঘোষের। পথদুর্ঘটনায় তিনি মাথায় চোট পেয়েছিলেন । নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বর্ধমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকায় তাঁকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার এই হাসপাতালে । ব্রেন ডেথ ঘোষণার পরে চিন্ময় ঘোষের অঙ্গদানে সম্মতি জানান পরিজনরা । তাঁর হার্ট, লিভার, দুই কিডনি, স্কিন এবং কর্নিয়া দান করা হয়েছে । অভিযোগ, ব্রেন ডেথ ঘোষণার পরও চিকিৎসার খরচ হিসাবে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের বিল পেশ করা হয়েছে।
চিন্ময় ঘোষের এক আত্মীয় অমিত বিশ্বাস বলেন, "এই বিপদের সময়ে সব বিল আমরা পরীক্ষা করে দেখিনি । সোমবার বিকালে যখন ব্রেন ডেথ হয় তখন একটি বিল দেওয়া হয়েছে । সোমবার দুপুরে একটি বিল দেওয়া হয়েছে । মঙ্গলবার সকাল 10টার সময় একটি বিল দেওয়া হয়েছে । আবার বিকাল তিনটার সময় একটি বিল দিয়েছে । কিন্তু, আমরা দেখছি ক্রমশ বিলগুলি বেড়ে গেছে । আমাদের মধ্যে তখন প্রশ্ন জাগে, ব্রেন ডেথ হয়ে যাওয়ার পরে এটা কী ভাবে সম্ভব?" একইসঙ্গে তিনি বলেন, "আসলে রবিবার রাতে রোগী মারা গেছে। তারপর ভেন্টিলেশনে ছিল । ব্রেন ডেথ ঘোষণার পরে ROTTO (রিজিওনাল অর্গান অ্যান্ড টিশু ট্রানস্প্লান্ট অরগানাইজেশন)-র কাছে অফিশিয়ালি দেহ হস্তান্তর হয়ে গেছে । এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে । এটা সোমবার বেলা দুটোর সময় হয়েছে । রাত আটটার সময় আবার করেছে । দুটোর সময় আমরা সই করে দিয়েছি। এই জন্যই তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পেরেছে । এরপরে ROTTO একটি OT নিয়ে এই কাজগুলি করেছে । তখন আমাদের এই বিলগুলি অবাস্তব ভাবে বেড়েছে ।"
বিল বেড়ে কত হয়েছিল ? অমিত বিশ্বাস বলেন, "যেমন, মঙ্গলবার ব্লাডব্যাঙ্কের 1200 টাকার একটি বিল দেওয়া হয়েছে । এটা কী ভাবে সম্ভব? বেড চার্জও ধরা হয়েছে । এরপরও আমরা মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করেছি যাতে মানুষের প্রাণ বাঁচে । আমরা ভাবতে পারিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান এরকম করতে পারে । আমরা বিশ্বাস করেছিলাম ।" চিকিৎসার খরচ হিসেবে কত টাকা দিয়েছেন হাসপাতালে? তিনি বলেন, "হাসপাতালের দাবি মতো আমরা পুরো টাকা দিয়েছি।" তিনি বলেন, "এমনও হয়েছে, মঙ্গলবার বেলা দশটার সময় আমাদের একটি বিল দিয়েছে । এরপর বেলা দুটোর সময় একটি বিল দেওয়া হয়েছে । ওষুধ ফেরত দেওয়া হয়েছে । বিল কমার কথা । বিল কী ভাবে বাড়তে পারে? ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে। মঙ্গলবার বেলা 11টার সময় যে বিল দিয়েছে, তার পরে বেলা তিনটার সময় বিল কী ভাবে বদল হয়? যদি প্রয়োজন হয় তা হলে এটা ROTTO দেবে। আমরা কেন দেব? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন কথা ঘুরিয়ে থাকতে পারে । কিন্তু মঙ্গলবার ব্লাডব্যাঙ্কের একটি বিল কী ভাবে আমাদের দেয়?" তিনি বলেন, "ব্রেন ডেথ ঘোষণার জন্য অ্যাপনিয়া টেস্ট করানো হয় । এর জন্য রক্ত পরীক্ষা করানো হয় । 700 টাকায় রক্ত পরীক্ষা করানো হয় । এই পরীক্ষার জন্য আমাদের বিল দেওয়া হয়েছে 12 হাজার টাকা ।"
এই বিষয়টি নিয়ে কোথাও অভিযোগ জানাবেন? অমিত বিশ্বাস বলেন, "অবশ্যই । আমরা যেমন বিজ্ঞান মানসিকতার পরিচয় দিয়েছি । আমরা যেমন হাসপাতাল, চিকিৎসকদের হেনস্থার বিরুদ্ধে । তেমনই এটাও ঠিক, মানুষকে যারা হেনস্থা করে, ঠকায়, আমরা তাদেরও বিরুদ্ধে।" হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও অভিযোগ জানিয়েছেন? তিনি বলেন, "বিল কমানোর জন্য আমরা আবেদন জানিয়েছিলাম।" তিনি বলেন, "দেখিয়েছে বিলে কোথাও কমানো হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, আবার অন্য জায়গায় ওই টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরকম করেছে।"
অভিযোগ কোথায় জানাবেন? তিনি বলেন, "রাজ্য সরকারের যে বিভাগ রয়েছে আমরা সেখানে অভিযোগ জানাব।" ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন রয়েছে । এখানে অভিযোগ জানাবেন? তিনি বলেন, "হ্যাঁ, রাজ্য সরকার যে সব কমিটি গড়েছে, আমরা সেখানে অভিযোগ জানাব। অভিযোগ মানে আমরা আবেদন করব। আমাদের নিজেদের জন্য নয়। কারণ আমরা পেমেন্ট করেছি। ভবিষ্যতে অন্য কোনও মানুষকে যাতে এরকম ঠকতে না হয়, এই জন্য আমরা করব।" অমিত বিশ্বাস বলেন, "2 লাখ 94 হাজার টাকা বিল হয়েছিল। আমাদের আবেদনের পরে 40 হাজার টাকা কমিয়ে আবার 22 হাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা 2 লাখ 71 হাজার 540 টাকা দিয়েছি।"
এই অভিযোগের বিষয়ে বেসরকারি ওই হাসপাতালের অ্যাডিশনাল CEO সব্যসাচী দত্তর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "ওরা আসলে বিল দেখে হয়ত বুঝতে পারেননি। ওদের মনে হয়েছে যে, ব্রেন ডেথ হওয়ার পরে আমরা চার্জ করেছি। কিন্তু, তা নয়। ব্রেন ডেথ হওয়ার পরে আমরা চার্জ করিনি। ওরা বিলে কিছু আইটেম দেখেছেন যেগুলি ব্রেন ডেথ হওয়ার পরে দেখা গেছে। আসলে এগুলি আমাদের ইনভেনশন ম্যানেজমেন্টের জন্য ইশু করা হয়েছে। কিন্তু, ডিসকাউন্টও করা হয়েছে। মানে নিট রেজ়াল্ট জ়িরো। এই অংশটির জন্য পেমেন্ট করতে হয়নি। হয়ত ওরা বুঝতে পারেননি।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "রোগীর পরিজনরা বাদেও অন্যরা থাকেন। বিভিন্ন মতামত থাকে। এই জন্য উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয়। এইটাই হয়েছে আসলে। ব্রেন ডেথ হওয়ার আগের যে ট্রিটমেন্ট, সেই খরচ থেকে আমরা 40 হাজার টাকা ডিসকাউন্ট করেছি। ব্রেন ডেথ ঘোষণার পর থেকে কোনও চার্জ নেওয়া হয়নি। ডিসকাউন্ট বাদ দিয়ে 2 লাখ 71 হাজার টাকা বিল হয়েছে।" রোগীর পরিজনদের ওই বিল কমানোর আবেদনের পরে বিল কমানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
কোনও রোগীর ব্রেন ডেথ ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে, ওই রোগীর বিভিন্ন অঙ্গ সচল রাখতে হয় অন্য রোগীদের শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য। এর জন্য, ব্রেন ডেথ ঘোষিত রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়, ব্লাড দিতে হয়। এ সবের জন্য যে খরচ হয়, বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে সেই খরচ ব্রেন ডেথ ঘোষিত রোগীর পরিজনদের কাছ থেকে নেওয়া হয় না। ROTTO সূত্রে খবর, এই খরচ হিসাবে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালকে 30 হাজার টাকা দেওয়া হয় ROTTO-র তরফে। যদিও, ROTTO-র কোনও কোনও আধিকারিক মনে করেন, এই 30 হাজার টাকা সেই অর্থে কম। টাকার এই অঙ্ক বাড়ানোর পক্ষেও মত রয়েছে ওই সব আধিকারিকের। কারণ, এর ফলে ব্রেন ডেথ ঘোষণার সংখ্যা বাড়বে। যার জেরে বিভিন্ন অঙ্গ সংগ্রহের পরিমাণও বাড়বে। সব মিলিয়ে উপকৃত হবে সাধারণ মানুষ। তবে, মঙ্গলবার বেসরকারি এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্রেন ডেথ ঘোষণার পরেও বিল বাড়ানোর যে অভিযোগ উঠেছে, তা বেসরকারি হাসপাতালে ব্রেন ডেথ ঘোষণার উপরে কতটা প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ে ROTTO-র কোনও কোনও আধিকারিক সংশয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে।