ETV Bharat / state

পুলিশকে তোলা দিলেই ছাড়, দেদার চলছে গোরু পাচারের কারবার - সুখবাজারের গোরু পাচার চক্র

পুলিশকে টাকা দিলেই পার হয়ে যায় গোরু । সুখবাজারের হাট থেকে ছোটো ম্যাটাডোর, ট্রাক, লরি করে গোরু রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পাচার হয় । পুলিশকর্মীরা আসেন । চালকদের সঙ্গে কথা বলেন । জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকা দেয় চালকরা । এরপরই ছাড়া হয় গাড়ি । গাড়ির আকার যত বাড়ে, তোলার অঙ্কও তত বাড়ে । ছোটো ম্যাটাডোর হলে 200 টাকা । বড় গাড়ি হলে 300 টাকা । লরিতে আরও বেশি... 500 টাকা ।

Cow trafficking in Birbhum
বীরভূমের গোরু পাচার
author img

By

Published : Oct 7, 2020, 3:37 PM IST

ইলামবাজার, 7 অক্টোবর : কোথায় কোথায় গোরু যায়? প্রশ্ন করতেই উত্তর এল, "মুর্শিদাবাদ যায়, বর্ধমানে যায়... ।" আর পুলিশ কিছু বলে না ? "কী বলবে ! কিছু বলে না । ওঁরা কিছু পয়সা-টয়সা নেয় । দু-একশো টাকা করে নেয় ।" পথে যে যে থানা পড়ে... বোলপুর, নানুর, কেতুগ্রাম... সব থানাই নাকি টাকা নেয় । কারবারিদের কথায়, "ওঁদের কাছে বেআইনি । আমরা পয়সা দিলেই ছাড় ।"

বীরভূমের ইলামবাজার । এখানেই রয়েছে সুখবাজারের মাঠ । দক্ষিণবঙ্গের সবথেকে বড় গোরুর হাট । হাট বসে প্রতি শনিবার । ফি সপ্তাহে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার গোরু কেনা-বেচা হয় এখানে । লেনদেন প্রায় চার-পাঁচ কোটির । আর এই হাটের আড়ালেই চলে গোরু পাচার । ইলামবাজার থেকে জঙ্গলের পথ দিয়ে গোরু চলে যায় মুর্শিদাবাদে । সেখান থেকে বাংলাদেশে ।

সংবাদমাধ্যম সহজে প্রবেশ করতে পারে না এই তল্লাটে । অপরিচিত মুখ দেখলেই প্রশ্ন করা হয় । জঙ্গল পথে রীতিমত চলে গোরু কারবারিদের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের নজরদারি । দীর্ঘদিন ধরে এই বেআইনি গোরুর কারবার চললেও স্থানীয় প্রশাসন কার্যত নির্বিকার ।

আরও পড়ুন : সীমান্তে গোরু-মাদক-সোনা পাচার ; ETV ভারতের মুখোমুখি BSF-র DIG

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর এই হাট থেকে গোরু পাচারের আড়ালে মিলেছিল জঙ্গিযোগ । পাচারকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের জামাত উল মুজাহিদিন জঙ্গিদের যোগ থাকার খবর সামনে এসেছিল । সুখবাজারের হাটে তদন্তে এসেছিলেন NIA-এর আধিকারিকরা । এদিকে, রাজ্যজুড়ে চলতে থাকা গোরু পাচারের মূল চক্রীদের ধরতে তদন্তে নেমেছে CBI । বীরভূম-মুর্শিদাবাদ এলাকা থেকে মাঝে মাঝেই পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করার খবর সামনে আসে । CBI-এর ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর থেকে বেশ কিছুটা ভাটা পড়েছে চোরাকারবারে । আগের তুলনায় গোরুর সংখ্যাও কমেছে হাটে । তবে এর মধ্যেও খুব সন্তর্পণে জঙ্গলের পথে হয়ে চলছে গোরুর বেআইনি কারবার ।

চলতি বছরের 11 সেপ্টেম্বরের একটি ঘটনায় ফের একবার শোরগোল পড়ে যায় গোরু পাচার নিয়ে । বীরভূমের নলহাটি থানার লোহাপুর এলাকা । দশ চাকার একটি কনটেইনার বেহাল রাস্তার কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উলটে যায় । কনটেইনারের ভিতরে ছিল 34 টি মোষ । এর মধ্যে 20 টি মোষ দুর্ঘটনায় মারা যায় । কনটেইনারটি বাংলাদেশের পথে যাচ্ছিল ।

Cow smuggling in Birbhum
জঙ্গলের পথ দিয়ে গোরু চলে যায় মুর্শিদাবাদে

আরও পড়ুন : বীরভূমে থেকে বাংলাদেশে গোরু পাচারের সময় উলটে গেল কন্টেনার, 20 মোষ মৃত

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, যেখানে CBI-এর এত কড়াকড়ি, সেখানে এতটা সাহস পাচ্ছে কীভাবে পাচারকারীরা । কারবারিদের একাংশ বলছে, পুলিশকে টাকা দিলেই মেলে গোরু নিয়ে যাওয়ার অনুমতি । ইলামবাজার, বোলপুর, নানুর... প্রতিটি থানাতেই টাকা দিতে হয় কারবারিদের । শুধু বীরভূম পুলিশই না, বর্ধমানের কাঁকসা, আউসগ্রাম থানা থেকেও গোরু পাচারের জন্য তোলা নেওয়া হয় । হাট থেকে ছোটো ম্যাটাডোর, ট্রাক, লরি করে গোরু রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পাচার হয় । গাড়ির আকার যত বাড়ে, তোলার অঙ্কও তত বাড়ে । ছোটো ম্যাটাডোর হলে 200 টাকা । বড় গাড়ি হলে 300 টাকা । লরিতে আরও বেশি... 500 টাকা । পুলিশকর্মীরা আসেন । চালকদের সঙ্গে কথা বলেন । জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকা দেয় চালকরা । এরপরই ছাড়া হয় গাড়ি । আর এইভাবেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গোরু পাচারের রমরমা কারবার ।

পুলিশকে টাকা দিলেই পার হয়ে যায় গোরু

আরও পড়ুন : 200-500 দিলে ছাড়া হচ্ছে গাড়ি, পুলিশি 'মদতে' রমরমিয়ে চলছে গোরু পাচার !

CBI আধিকারিক সূত্রে খবর, সুখবাজারের হাট থেকে গোরু পাচারের দু'টি চোরা পথ রয়েছে । সুখবাজারের মাঠ থেকে অজয় নদ খুব বেশি দূরে নয় । ইলামবাজার থেকে জঙ্গলের পথ ধরে একটু এগিয়ে গেলেই অজয় নদ । নদ পার হলেই বর্ধমান । সেখান থেকে বিভিন্ন জেলায় চলে যায় গোরু ।

অন্য একটি পথও রয়েছে । ইলামবাজার থেকে জঙ্গলের রাস্তা হয়ে বোলপুর । সেখান থেকে নানুর হয়ে মুর্শিদাবাদে ঢুকে যায় গোরু বোঝাই গাড়ি । নম্বর প্লেটহীন লরি করে ইলামবাজার থেকে জঙ্গলপথে চলে গোরু পাচার । মুর্শিদাবাদ হল গোরু পাচারের অন্যতম বড় আখড়া । এখানে বেশ সক্রিয় এনামুল শেখের গোরু পাচার চক্র । এনামুলের লোকেদের হাত ধরেই চোরাপথে সীমান্তের ওপারে চলে যায় গোরু ।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশে গোরু পাচার চলে রমরমিয়ে, পুলিশকে টাকা দিলেই কেল্লাফতে !

সুখবাজারের গোরু পাচারচক্রের অন্যতম পান্ডা এই এনামুল । CBI আধিকারিকরা মাঝে তাকে গ্রেপ্তারও করেছিল । পরে সে জামিনে ছাড়া পায় । তবে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর ফের পলাতক এনামুল । বোলপুরের একাধিক জায়গায় বিভিন্ন সম্পত্তি তার নামে । সেগুলির উপরেও নজর রয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার । কিন্তু তার মধ্যেও দেদার চলছে কারবার । সম্পূর্ণ ঢাকা কনটেইনার করে ইলামবাজার থেকে গোরু মুর্শিদাবাদ হয়ে চলে যায় বাংলাদেশে ।

Cow smuggling in Birbhum
ভ্যানে করে গোরু বেঁধে নিয়ে আসা হয় হাটে

সুখবাজারের এই হাট প্রতি শনিবার বসলেও শুক্রবার রাত থেকেই ভিড় জমতে থাকে । জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গোরু নিয়ে এসে এই হাটে মজুত করা হয় । শুধু বীরভূমই না, বাইরের জেলা থেকেও গোরু বেচতে নিয়ে আসা হয় এখানে । শনিবার সকাল হতেই শুরু হয় বেচা-কেনা । এক এক গোরুর এক এক দাম । ওজনের উপর এক একটি গোরুর দাম 30 হাজার টাকা থেকে শুরু করে 80 হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে যায় । সূত্রের খবর, ফি সপ্তাহে এই হাট থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে এক থেকে দেড় হাজার গোরু বাংলাদেশে যায় । আর একবার সীমান্ত পার করে গেলেই চড়া দাম পাওয়া যায় গোরুর । এক একটি গোরুর দাম বেড়ে হয়ে যায় 1 লাখ 10 হাজার টাকা থেকে শুরু করে 1 লাখ 50 হাজার টাকা । তাই বাংলাদেশে গোরু পাচার না হলে, সেভাবে লাভ হয় না কারবারিদের ।

আরও পড়ুন : পাচারের আগে উদ্ধার 183টি গোরু, ডুব সাঁতার দিয়ে পালাল পাচারকারীরা !

আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনানুযায়ী কোনও ব্যক্তি হেঁটে হেঁটে একটি বা দু'টি গোরু নিয়ে গেলে তা বৈধ । কিন্তু, একাধিক গোরু গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া মানেই তা পাচার । অবৈধ । জঙ্গলপথে বেআইনিভাবে গোরু নিয়ে যাওয়ার পথে যদি বন দপ্তরের হাতে ধরা পড়ে, তবে মামলা হয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের আওতায় । আর পুলিশ ধরলে প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল রুল ।

Cow smuggling in Birbhum
সুখবাজারের এই মাঠেই বসে দক্ষিণবঙ্গের সবথেকে বড় গোরুর হাট

পশুদের উপর অত্যাচার বন্ধ করতে কেন্দ্র 2017 সালে প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল রুল চালু করে । কার্যত এই ধরনের গোরু বা অন্যান্য পশুর বাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই এই আইন চালু করা হয় । এবার দেখে নেওয়া যাক, কী বলা হয়েছে এই আইনে । আইনের 22 (বি) (3 নং) ধারা অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তিকে পশু বাজারে গোরু বা অন্য কোনও গবাদি পশু বিক্রি করতে নিয়ে যেতে হলে, তাঁর কাছে লিখিত অনুমতি থাকতে হবে যে প্রাণীটিকে হত্যা করার জন্য বা পাচার করার জন্য বিক্রি করা হচ্ছে না ।

আইনের 22 (ই) (1 নং) ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ওই গবাদি পশুটি কিনবেন তিনিও পশুটিকে হত্যা করার জন্য পুনরায় বিক্রি করতে পারবেন না ।

বাংলাদেশ তো দূরে থাক, আইন অনুযায়ী, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যেও বিক্রি করা যায় না গোরু । কারণ, গো-হত্যা সংক্রান্ত এক এক রাজ্যে এক এক ধরনের আইন চালু রয়েছে । এক রাজ্য থেকে গোরু কিনে যাতে অন্য রাজ্যে নিয়ে গিয়ে হত্যা না করা হয় সেই কারণেই এই নিয়ম ।

Cow smuggling in Birbhum
পথে প্রতিটি থানাতেই দিতে হয় টাকা

আরও পড়ুন : গোরু পাচারের জন্য নষ্ট ফসল, ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

পশ্চিমবঙ্গে যেমন গোহত্যা আইনত নিষিদ্ধ নয় । তবে সেক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে । গোহত্যা করতে গেলে লাগবে গোরুটি যে হত্যা করার যোগ্য, তার প্রমাণপত্র । আইনের মতে, কোনও গোরুকে হত্যা করতে হলে তার বয়স 14 বছরের বেশি হতে হবে এবং কাজ করার বা প্রসবে অক্ষম হতে হবে । অথবা, বয়স, আঘাত, শারীরিক গঠনগত ত্রুটি বা নিরাময়যোগ্য নয় এমন কোনও রোগের কারণে গোরুটি যদি কর্মশক্তি বা প্রসব ক্ষমতা হারায়, তাহলেও সেটি হত্যা করার উপযুক্ত । শুধু গোরু নয়, ষাঁড়, বদল, মোষের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য । আইন ভাঙলে ছয় মাসের জেল অথবা এক হাজার টাকার জরিমানা অথবা উভয়ই হতে পারে ।

2018 সালে এনামুলকে যখন গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিল CBI, তখন গোয়েন্দাদের হাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছিল । সীমান্ত দিয়ে একজোড়া গোরু পাচার করতে 62 হাজার টাকা নিত এনামুলের সিন্ডিকেট । সংবাদমাধ্যমের একাংশে প্রকাশ, এই টাকার একটি অংশ হিস্সা পেত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকিও । জিজ্ঞাসাবাদে তৎকালীন এক মন্ত্রী, এক সাংসদ ও এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীয় নিকটাত্মীয়ের নাম জড়িয়েছিল বলেও সংবাদমাধ্যমের একাংশে প্রকাশ হয়েছিল । আর এনামুলের এই পাচার চক্রের বেশিরভাগ গোরুই ছিল সুখবাজারের গোরুহাটের ।

আরও পড়ুন : গোরু পাচারে BSF-র যোগসূত্রের অভিযোগ, তদন্তে CBI

এ এক বিরাট চক্র । পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদ জেলার বেশ কিছু প্রভাবশালী মানুষের নাম জড়িয়েছে এই গোরু পাচারের ঘটনা । আর পুলিশের তোলা নেওয়ার বিষয়টি তো স্বীকারই করে নিয়েছেন কারবারিদের একাংশ । কোনও ঝক্কি নেই । টাকা দিলেই ম্যাটাডোর করে গোরু চলে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে । আর এই গোটা ঘটনায় কার্যত নিরব স্থানীয় প্রশাসন । মুখে কুলুপ আঁটা যাকে বলে আর কি । তবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা গোরু পাচারের বিষয়ে তদন্তে নামার পর থেকে অনেকটা ভাটা পড়েছে চোরাচালানে ।

ইলামবাজার, 7 অক্টোবর : কোথায় কোথায় গোরু যায়? প্রশ্ন করতেই উত্তর এল, "মুর্শিদাবাদ যায়, বর্ধমানে যায়... ।" আর পুলিশ কিছু বলে না ? "কী বলবে ! কিছু বলে না । ওঁরা কিছু পয়সা-টয়সা নেয় । দু-একশো টাকা করে নেয় ।" পথে যে যে থানা পড়ে... বোলপুর, নানুর, কেতুগ্রাম... সব থানাই নাকি টাকা নেয় । কারবারিদের কথায়, "ওঁদের কাছে বেআইনি । আমরা পয়সা দিলেই ছাড় ।"

বীরভূমের ইলামবাজার । এখানেই রয়েছে সুখবাজারের মাঠ । দক্ষিণবঙ্গের সবথেকে বড় গোরুর হাট । হাট বসে প্রতি শনিবার । ফি সপ্তাহে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার গোরু কেনা-বেচা হয় এখানে । লেনদেন প্রায় চার-পাঁচ কোটির । আর এই হাটের আড়ালেই চলে গোরু পাচার । ইলামবাজার থেকে জঙ্গলের পথ দিয়ে গোরু চলে যায় মুর্শিদাবাদে । সেখান থেকে বাংলাদেশে ।

সংবাদমাধ্যম সহজে প্রবেশ করতে পারে না এই তল্লাটে । অপরিচিত মুখ দেখলেই প্রশ্ন করা হয় । জঙ্গল পথে রীতিমত চলে গোরু কারবারিদের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের নজরদারি । দীর্ঘদিন ধরে এই বেআইনি গোরুর কারবার চললেও স্থানীয় প্রশাসন কার্যত নির্বিকার ।

আরও পড়ুন : সীমান্তে গোরু-মাদক-সোনা পাচার ; ETV ভারতের মুখোমুখি BSF-র DIG

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর এই হাট থেকে গোরু পাচারের আড়ালে মিলেছিল জঙ্গিযোগ । পাচারকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের জামাত উল মুজাহিদিন জঙ্গিদের যোগ থাকার খবর সামনে এসেছিল । সুখবাজারের হাটে তদন্তে এসেছিলেন NIA-এর আধিকারিকরা । এদিকে, রাজ্যজুড়ে চলতে থাকা গোরু পাচারের মূল চক্রীদের ধরতে তদন্তে নেমেছে CBI । বীরভূম-মুর্শিদাবাদ এলাকা থেকে মাঝে মাঝেই পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করার খবর সামনে আসে । CBI-এর ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর থেকে বেশ কিছুটা ভাটা পড়েছে চোরাকারবারে । আগের তুলনায় গোরুর সংখ্যাও কমেছে হাটে । তবে এর মধ্যেও খুব সন্তর্পণে জঙ্গলের পথে হয়ে চলছে গোরুর বেআইনি কারবার ।

চলতি বছরের 11 সেপ্টেম্বরের একটি ঘটনায় ফের একবার শোরগোল পড়ে যায় গোরু পাচার নিয়ে । বীরভূমের নলহাটি থানার লোহাপুর এলাকা । দশ চাকার একটি কনটেইনার বেহাল রাস্তার কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উলটে যায় । কনটেইনারের ভিতরে ছিল 34 টি মোষ । এর মধ্যে 20 টি মোষ দুর্ঘটনায় মারা যায় । কনটেইনারটি বাংলাদেশের পথে যাচ্ছিল ।

Cow smuggling in Birbhum
জঙ্গলের পথ দিয়ে গোরু চলে যায় মুর্শিদাবাদে

আরও পড়ুন : বীরভূমে থেকে বাংলাদেশে গোরু পাচারের সময় উলটে গেল কন্টেনার, 20 মোষ মৃত

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, যেখানে CBI-এর এত কড়াকড়ি, সেখানে এতটা সাহস পাচ্ছে কীভাবে পাচারকারীরা । কারবারিদের একাংশ বলছে, পুলিশকে টাকা দিলেই মেলে গোরু নিয়ে যাওয়ার অনুমতি । ইলামবাজার, বোলপুর, নানুর... প্রতিটি থানাতেই টাকা দিতে হয় কারবারিদের । শুধু বীরভূম পুলিশই না, বর্ধমানের কাঁকসা, আউসগ্রাম থানা থেকেও গোরু পাচারের জন্য তোলা নেওয়া হয় । হাট থেকে ছোটো ম্যাটাডোর, ট্রাক, লরি করে গোরু রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পাচার হয় । গাড়ির আকার যত বাড়ে, তোলার অঙ্কও তত বাড়ে । ছোটো ম্যাটাডোর হলে 200 টাকা । বড় গাড়ি হলে 300 টাকা । লরিতে আরও বেশি... 500 টাকা । পুলিশকর্মীরা আসেন । চালকদের সঙ্গে কথা বলেন । জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকা দেয় চালকরা । এরপরই ছাড়া হয় গাড়ি । আর এইভাবেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গোরু পাচারের রমরমা কারবার ।

পুলিশকে টাকা দিলেই পার হয়ে যায় গোরু

আরও পড়ুন : 200-500 দিলে ছাড়া হচ্ছে গাড়ি, পুলিশি 'মদতে' রমরমিয়ে চলছে গোরু পাচার !

CBI আধিকারিক সূত্রে খবর, সুখবাজারের হাট থেকে গোরু পাচারের দু'টি চোরা পথ রয়েছে । সুখবাজারের মাঠ থেকে অজয় নদ খুব বেশি দূরে নয় । ইলামবাজার থেকে জঙ্গলের পথ ধরে একটু এগিয়ে গেলেই অজয় নদ । নদ পার হলেই বর্ধমান । সেখান থেকে বিভিন্ন জেলায় চলে যায় গোরু ।

অন্য একটি পথও রয়েছে । ইলামবাজার থেকে জঙ্গলের রাস্তা হয়ে বোলপুর । সেখান থেকে নানুর হয়ে মুর্শিদাবাদে ঢুকে যায় গোরু বোঝাই গাড়ি । নম্বর প্লেটহীন লরি করে ইলামবাজার থেকে জঙ্গলপথে চলে গোরু পাচার । মুর্শিদাবাদ হল গোরু পাচারের অন্যতম বড় আখড়া । এখানে বেশ সক্রিয় এনামুল শেখের গোরু পাচার চক্র । এনামুলের লোকেদের হাত ধরেই চোরাপথে সীমান্তের ওপারে চলে যায় গোরু ।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশে গোরু পাচার চলে রমরমিয়ে, পুলিশকে টাকা দিলেই কেল্লাফতে !

সুখবাজারের গোরু পাচারচক্রের অন্যতম পান্ডা এই এনামুল । CBI আধিকারিকরা মাঝে তাকে গ্রেপ্তারও করেছিল । পরে সে জামিনে ছাড়া পায় । তবে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর ফের পলাতক এনামুল । বোলপুরের একাধিক জায়গায় বিভিন্ন সম্পত্তি তার নামে । সেগুলির উপরেও নজর রয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার । কিন্তু তার মধ্যেও দেদার চলছে কারবার । সম্পূর্ণ ঢাকা কনটেইনার করে ইলামবাজার থেকে গোরু মুর্শিদাবাদ হয়ে চলে যায় বাংলাদেশে ।

Cow smuggling in Birbhum
ভ্যানে করে গোরু বেঁধে নিয়ে আসা হয় হাটে

সুখবাজারের এই হাট প্রতি শনিবার বসলেও শুক্রবার রাত থেকেই ভিড় জমতে থাকে । জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গোরু নিয়ে এসে এই হাটে মজুত করা হয় । শুধু বীরভূমই না, বাইরের জেলা থেকেও গোরু বেচতে নিয়ে আসা হয় এখানে । শনিবার সকাল হতেই শুরু হয় বেচা-কেনা । এক এক গোরুর এক এক দাম । ওজনের উপর এক একটি গোরুর দাম 30 হাজার টাকা থেকে শুরু করে 80 হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে যায় । সূত্রের খবর, ফি সপ্তাহে এই হাট থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে এক থেকে দেড় হাজার গোরু বাংলাদেশে যায় । আর একবার সীমান্ত পার করে গেলেই চড়া দাম পাওয়া যায় গোরুর । এক একটি গোরুর দাম বেড়ে হয়ে যায় 1 লাখ 10 হাজার টাকা থেকে শুরু করে 1 লাখ 50 হাজার টাকা । তাই বাংলাদেশে গোরু পাচার না হলে, সেভাবে লাভ হয় না কারবারিদের ।

আরও পড়ুন : পাচারের আগে উদ্ধার 183টি গোরু, ডুব সাঁতার দিয়ে পালাল পাচারকারীরা !

আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনানুযায়ী কোনও ব্যক্তি হেঁটে হেঁটে একটি বা দু'টি গোরু নিয়ে গেলে তা বৈধ । কিন্তু, একাধিক গোরু গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া মানেই তা পাচার । অবৈধ । জঙ্গলপথে বেআইনিভাবে গোরু নিয়ে যাওয়ার পথে যদি বন দপ্তরের হাতে ধরা পড়ে, তবে মামলা হয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের আওতায় । আর পুলিশ ধরলে প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল রুল ।

Cow smuggling in Birbhum
সুখবাজারের এই মাঠেই বসে দক্ষিণবঙ্গের সবথেকে বড় গোরুর হাট

পশুদের উপর অত্যাচার বন্ধ করতে কেন্দ্র 2017 সালে প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল রুল চালু করে । কার্যত এই ধরনের গোরু বা অন্যান্য পশুর বাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই এই আইন চালু করা হয় । এবার দেখে নেওয়া যাক, কী বলা হয়েছে এই আইনে । আইনের 22 (বি) (3 নং) ধারা অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তিকে পশু বাজারে গোরু বা অন্য কোনও গবাদি পশু বিক্রি করতে নিয়ে যেতে হলে, তাঁর কাছে লিখিত অনুমতি থাকতে হবে যে প্রাণীটিকে হত্যা করার জন্য বা পাচার করার জন্য বিক্রি করা হচ্ছে না ।

আইনের 22 (ই) (1 নং) ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ওই গবাদি পশুটি কিনবেন তিনিও পশুটিকে হত্যা করার জন্য পুনরায় বিক্রি করতে পারবেন না ।

বাংলাদেশ তো দূরে থাক, আইন অনুযায়ী, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যেও বিক্রি করা যায় না গোরু । কারণ, গো-হত্যা সংক্রান্ত এক এক রাজ্যে এক এক ধরনের আইন চালু রয়েছে । এক রাজ্য থেকে গোরু কিনে যাতে অন্য রাজ্যে নিয়ে গিয়ে হত্যা না করা হয় সেই কারণেই এই নিয়ম ।

Cow smuggling in Birbhum
পথে প্রতিটি থানাতেই দিতে হয় টাকা

আরও পড়ুন : গোরু পাচারের জন্য নষ্ট ফসল, ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

পশ্চিমবঙ্গে যেমন গোহত্যা আইনত নিষিদ্ধ নয় । তবে সেক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে । গোহত্যা করতে গেলে লাগবে গোরুটি যে হত্যা করার যোগ্য, তার প্রমাণপত্র । আইনের মতে, কোনও গোরুকে হত্যা করতে হলে তার বয়স 14 বছরের বেশি হতে হবে এবং কাজ করার বা প্রসবে অক্ষম হতে হবে । অথবা, বয়স, আঘাত, শারীরিক গঠনগত ত্রুটি বা নিরাময়যোগ্য নয় এমন কোনও রোগের কারণে গোরুটি যদি কর্মশক্তি বা প্রসব ক্ষমতা হারায়, তাহলেও সেটি হত্যা করার উপযুক্ত । শুধু গোরু নয়, ষাঁড়, বদল, মোষের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য । আইন ভাঙলে ছয় মাসের জেল অথবা এক হাজার টাকার জরিমানা অথবা উভয়ই হতে পারে ।

2018 সালে এনামুলকে যখন গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিল CBI, তখন গোয়েন্দাদের হাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছিল । সীমান্ত দিয়ে একজোড়া গোরু পাচার করতে 62 হাজার টাকা নিত এনামুলের সিন্ডিকেট । সংবাদমাধ্যমের একাংশে প্রকাশ, এই টাকার একটি অংশ হিস্সা পেত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকিও । জিজ্ঞাসাবাদে তৎকালীন এক মন্ত্রী, এক সাংসদ ও এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীয় নিকটাত্মীয়ের নাম জড়িয়েছিল বলেও সংবাদমাধ্যমের একাংশে প্রকাশ হয়েছিল । আর এনামুলের এই পাচার চক্রের বেশিরভাগ গোরুই ছিল সুখবাজারের গোরুহাটের ।

আরও পড়ুন : গোরু পাচারে BSF-র যোগসূত্রের অভিযোগ, তদন্তে CBI

এ এক বিরাট চক্র । পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদ জেলার বেশ কিছু প্রভাবশালী মানুষের নাম জড়িয়েছে এই গোরু পাচারের ঘটনা । আর পুলিশের তোলা নেওয়ার বিষয়টি তো স্বীকারই করে নিয়েছেন কারবারিদের একাংশ । কোনও ঝক্কি নেই । টাকা দিলেই ম্যাটাডোর করে গোরু চলে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে । আর এই গোটা ঘটনায় কার্যত নিরব স্থানীয় প্রশাসন । মুখে কুলুপ আঁটা যাকে বলে আর কি । তবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা গোরু পাচারের বিষয়ে তদন্তে নামার পর থেকে অনেকটা ভাটা পড়েছে চোরাচালানে ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.