বাঁকুড়া : আদিবাসীদের দেবতা তো মারাংবুরু ৷ আর সেই আদিবাসীরাই কি না দুর্গাপুজো করবেন ! মেনে নেননি অনেকেই ৷ রক্তচক্ষু ছিল গ্রামের মোড়লদেরও ৷ ভয় ছিল, গ্রামে একঘরে হওয়ার ৷ তাতে অবশ্য পিছিয়ে আসেননি বাঁকুড়ার দোমোহানি গ্রামের কয়েকজন আদিবাসী মহিলা ৷ বরং আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন নিজেদের দুর্গাপুজোকে ৷ আর এভাবেই 14 বছর ধরে মারাংবুরুর মন্ত্র পাঠ করে, সাঁওতালি ভাষায় গান গেয়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করে আসছেন ওই মহিলারা ৷
বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় 50 কিলোমিটার দূরে এই দোমোহানি গ্রাম ৷ 50-60 টি আদিবাসী পরিবারের বাস ৷ সেখানেই থাকেন সন্ধ্যা হেমরম ৷ নিজস্ব ছন্দেই চলছিল তাঁর জীবন ৷ কিন্তু, 14 বছর আগে এক স্বপ্নই পালটে জীবনের গতিমুখ ৷ গ্রামেরই এক বাসিন্দা সরস্বতী হাঁসদা শোনালেন সেই কাহিনি ৷ তিনি বলেন, "একদিন মা স্বপ্নে দেখা দেন ৷ এসে বললেন, তাঁর পুজো করতে হবে ৷ কিন্তু, বলা হয় আদিবাসীদের মধ্যে তো দুর্গাপুজো নেই ৷ তাহলে কেউ যদি কিছু বলে ? মা বলেন, না ৷ আমাকে পুজো দিতেই হবে ৷" তারপর আর সাত-পাঁচ ভাবেননি একেবারে সাদাসিধে প্রকৃতির সন্ধ্যা ৷ এক অদ্ভুত জেদ চেপে বসে তাঁর মধ্যে ৷ পাশে পান আরও কয়েকজন মহিলাকে ৷
কিন্তু, মারাংবুরুয়ের পরিবর্তে গ্রামে দুর্গাপুজো হবে ? তাও আবার কি না মহিলারা করবে সেই পুজো ৷ সায় দেননি গ্রামের মোড়ালরা ৷ পুজো আটকানোর জন্য থানাতেও যান তাঁরা ৷ গ্রামেরই এক বাসিন্দা মতিলাল হাঁসদা বলেন, "ওরা বলে, মানুষ কাটা হচ্ছে ৷ তাই বাধা দেওয়া হচ্ছে ৷ যদিও পুলিশ তদন্ত করে দেখে এরকম কিছু হচ্ছে না ৷ তারপর বড়বাবু বলেন, পুজো করার অধিকার সবার রয়েছে ৷ পুজো হবে ৷ কোনও বাধা দিতে পারবে না ৷ "
পুলিশের বরাভয় যেন আরও সাহস বাড়িয়ে দেয় সন্ধ্যাদের ৷ শুরু হয় পুজো ৷ অবশ্য প্রতিমা নয়, প্রথম বছর ঘট পুজোই করা হয় ৷ তা অবশ্য মেনে নেননি প্রতিবেশীরা ৷ বাঁকা চোখে তাকাতে থাকেন তাঁরা ৷ কিন্তু,অদম্য জেদ চেপে বসে সন্ধ্যাদের মধ্যে ৷ সরস্বতী জানান, এরপর ফের দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান ৷ তাঁর কথায়, "দ্বিতীয় বছরে মা বললেন, আমার মূর্তি পুজো করতে হবে ৷ আমার মূর্তি দেখাতে হবে ৷" এরপর থেকেই শুরু হয় প্রতিমা পুজো ৷ তবে সেখানে সাবেকি মন্ত্র পাঠ বা চন্ডীপাঠ হয় না ৷ সাঁওতালি ভাষায় গান গেয়ে, মারাংবুরুর মন্ত্র পাঠ করে আরাধনা করা হয় দেবী দুর্গার ৷ এভাবেই দুর্গাপুজোর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে আদিবাসী সংস্কৃতি ৷
কিন্তু, পুজোর জন্য অর্থ কীভাবে পান ? নিজেদের সাধ্যমতোই চাঁদা তোলেন ৷ জানেনও না হয়তো সরকার অনেক পুজোকে অনুদান দেয় ৷ সেই সাহায্যের ছিটেফোঁটাও পান না তাঁরা ৷ জানলেও অবশ্য ভ্রূক্ষেপ করতেন না তাঁরা ৷ তাঁদের তো সম্বল বলতে নিষ্ঠা ও ভক্তি ৷ আর তার সামনে বারেবারে হার মেনেছে সব প্রতিকূলতা ৷ আর সফলও হচ্ছে তাঁদের সেই অদম্য ইচ্ছা ৷ ক্রমশ এই পুজোকে গ্রহণ করছেন গ্রামের মানুষরা ৷ অনেকেরই ভাবনাচিন্তাতে পরিবর্তনও এসেছে বলে জানান পুজোর সঙ্গে যুক্ত সরস্বতী ৷ বলেন, "এখন মানুষ নিজে খুশি খুশি পুজো দিতে আসেন ৷ অর্ধেক মানুষ মেনে নিয়েছেন ৷ বাকিরা মানেননি ৷ গ্রামের বাইরে থেকেও অনেকে আসেন ৷" তাঁর আশা, অচিরেই সবাই মেনে নেবেন এই দেবী দুর্গা ও মারাংবুরুর মেলবন্ধন ৷ সেই স্বপ্ন নিয়েই আরও একটা বছর দেবী দুর্গার আগমনের অপেক্ষায় রয়েছেন সন্ধ্যা, সরস্বতীরা ৷