আলিপুরদুয়ার, 5 সেপ্টেম্বর: রক্ষকই ভক্ষক ৷ এমন খবর শিরোনামে এসেছে বেশ কয়েকবার ৷ তবে আজকের খবরে রক্ষকই শিক্ষক । শুধু শিক্ষক নয় ৷ তিনি পেশায় পুলিশ সুপার হলেও বর্তমানে আলিপুরদুয়ার চা বলয়ের দুঃস্থ মেধাবী পড়ুয়াদের কাছে তিনি আজ অভিভাবক ৷ আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি পড়ুয়াদের জন্য চালাচ্ছেন বিনামূল্যে অনলাইন কোচিং ক্লাস ৷ সেখানে পড়াশোনা করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি পেয়ে উপকৃত বীরপাড়া, কালচিনি-সহ ডুয়ার্সের বিভিন্ন অংশের গরিব ছাত্রছাত্রীরা । মিলছে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগও ৷ পুলিশ সুপার ওয়াই রঘুবংশী এখন পরিচিত এলাকার মাস্টার মশাই হিসেবে ৷
আলিপুরদুয়ার জেলার চা বলয়ের দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের অনেকেই মেধাবী হলেও পড়াশোনার সুযোগ সুবিধের অভাবে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না ৷ এটা জানতে পেরেই অনলাইন কোচিং ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন পুলিশ সুপার ওয়াই রঘুবংশী । নিজের বন্ধু, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী থেকে শুরু করে যাঁরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কোচিং দেন, তাঁদেরকে সেই কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত করেন তিনি । মেধাবী পড়ুয়ারা যাতে থানায় গিয়ে পড়াশোনা করতে পারে সে জন্য থানার ওয়াইফাই ব্যবহার করারও অনুমতি দিয়েছেন তিনি । প্রতিটি থানায় সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ এ ছাড়াও প্রতিটি থানাতে 'কৌশিশ' নামে প্রশিক্ষণশালার ব্যবস্থা করেছেন পুলিশ সুপার ৷ আইআইটি, ডব্লিউবিসিএস-সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার পাঠ দেওয়া হয় তাঁর কোচিং ক্লাসে ৷ এর ফলে এসেছে সাফল্যও ৷
পুলিশ সুপারের কথায়, "আমি মাস্টার মশাইয়ের জায়গা কোনওদিনই নিতে পারব না । তবে ছাত্রসমাজকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য কাজ করতে পারব । আর এটা আমাদের সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য ।"
ওয়াই রঘুবংশী হায়দরাবাদের সন্তান । রাজ্যের খড়গপুর আইআইটি থেকে পাশ করার পর 2013 সালে আইপিএস হন । তিনি বলেন, "কমিউনিটি পোলিসিং আমরা করি । সরকার থেকেও বলা হয়েছে যুবদের উপর নজর রাখতে । তাঁদের সমস্যার সমাধান করতে । পুলিশ তাঁদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলে যদি তাঁদের সমস্যার সমাধান হয়, তাহলে তাঁরা ভুল পথে চালিত হবেন না । সেই দিক থেকে এই দুঃস্থ মেধাবী ছেলেমেয়েদের কী কী লাগবে সেটা দেখা হয় ।"
আরও পড়ুন: করোনা সচেতেনতায় রাস্তায় জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার
তিনি শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন বলে জানান রঘুবংশী ৷ তাঁর কথায়, "ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ ছিল । তারা পরীক্ষায় সফল হতে পারে না । কোথায় পড়তে হয়, কতক্ষণ পড়তে হয়, সেটা জানা দরকার । এরপরেই আমি বিভিন্ন শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি । কারণ আমার পক্ষে সবাইকে কোচিং দেওয়া সম্ভব নয় । সেটা দুই-একদিন হতে পারে কিন্তু সারা বছর সম্ভব নয় । আমরা বা আমাদের অফিসাররা সবাই কিন্তু কোনও না কোনও পরীক্ষাতে পাশ করেই চাকরি পেয়েছেন ৷ তাঁদেরকেও কাজে লাগানো হয়েছে এই কোচিং ক্লাসে । কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করি । বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এই কোচিং ক্লাসের জন্য জড়িয়ে নিই । জেলার মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা নিয়ে তাদের সিলেক্ট করে কোচিং শুরু হয় । আমার যাঁরা বন্ধু দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন জায়গায় কোচিং সেন্টার চালান, তাঁদেরও সহযোগিতা নিয়েছি ।"
জেলার বীরপাড়া, কালচিনি, শামুকতলা থানাতে কোচিং চলছে । বীরপাড়া কোচিং সেন্টার থেকেই 25 জন ছেলেমেয়ে চাকরি পেয়েছে । রেল, অগ্নিবীর, গ্রুপ ডি, পুলিশ কস্টেবল-সহ বিভিন্ন জায়গায় চাকরি পেয়েছেন তারা । রঘুবংশী বলেন, "মেধার অভাব নেই ৷ তবে তাঁদের লক্ষ্য স্থির করে সঠিক ভাবে তালিম দেওয়াটাই কঠিন কাজ । আলিপুরদুয়ার জেলার চা বলয়ে বা গরিব পরিবারের কাছে এই সব কোচিং নেওয়াটা খুবই কষ্টকর । যারা ক্লাস করছে তারা সবাই ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার ৷"
আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি ভার্নোবাড়ি চা শ্রমিকের সন্তান মণীশ ওড়াও মিঞ্জ বলেন, পুলিশ সুপারের অনলাইন কোচিং-এর ফলে তিনি উপকৃত হয়েছেন । এ বার মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন । মণীশের বাবা রঘু মিঞ্জের কথায়, "পুলিশ সুপারের উদ্যোগের ফলে চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের অনেকের উপকার হয়েছে । কারণ একজন শ্রমিকের পক্ষে জেইই বা আইআইটি-র মতো কোচিং দেওয়া সম্ভব নয় । আমার ছেলে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পড়ার সুযোগ পেয়েছে একমাত্র পুলিশ সুপারের জন্য । তাঁর মতো একজন শিক্ষককে আমরা অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি ।"
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আলিপুরদুয়ার মানবিক মুখের সম্পাদক রাতুল বিশ্বাস জানান, "পুলিশ সুপারের অনলাইন কোচিং-এ আমাদেরকেও যুক্ত করা হয়েছে । এতে প্রচুর দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রীর উপকার হয়েছে । ওয়াই রঘুবংশী শুধু পুলিশ আধিকারিক নন, তিনি একজন আদর্শ শিক্ষকও বটে । এই কাজে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি । সবাই এগিয়ে এসেছেন কোচিং-এর জন্য ।"
যে জন্মেছে, সে জন্মানোদের সাহায্য চায়...এই কথাটাই মাথায় রেখে যেন এগিয়ে চলেছেন আলিপুরদুয়ারের পুলিশ সুপার ওয়াই রঘুবংশী ৷ পেশার বাইরে বেরিয়ে ভবিষ্যতের সমাজ গড়ে তোলার কারিগর হয়ে উঠেছেন তিনি ৷ ডুয়ার্সের চা বলয়ের মানুষের কাছে তিনি আজ সাক্ষাৎ ভগবান ৷