কলকাতা, 14 জুন: এন্টালি মার্কেটের পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে সোজা ঢুকে ডানদিকে ঘুরলেই মাছের বাজার । মধ্য কলকাতার অন্যতম এই পুরোনো বাজারে বিকিকিনি চলে সারাদিন ধরে । আর এই বাজারে মাছ কিনতে এলে মাঝারি উচ্চতার এক যুবককে অবশ্যই চোখে পড়বে । নাম রাম সাহানি । বয়স তিরিশ । তাকেন সোদপুরে । বাজারে ঘুরে ঘুরে মাছের ব্রেন সংগ্রহ করা এবং সিভিক পুলিশের চাকরিই তাঁর পেশা । আর নেশা- বক্সিং ।
বিহারের পটনার বাসিন্দা রাম সাহানি জাতীয় বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের পদক জয়ী ৷ বিজেন্দর সিং সহ দেশের তারকা বক্সারদের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে ৷ বাড়িতে রয়েছে একাধিক সার্টিফিকেট আর পদক ৷ কিন্তু সেই সাফল্য রাজ্য ও জাতীয় স্তরে 16টি পদক জয়ী রামকে ভাতের জোগানের ব্যবস্থা করে দেয়নি ৷ পরিবারের ছয়জন সদস্য তাঁর দিকেই চেয়ে ৷ তাঁদের মুখে অন্ন জোগাতে মাছের বাজারে কাজ সেরে সোজা চলে যান শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে ৷ সেখানে সিভিক পুলিশের কাজ করেন ৷ এভাবে যা রোজগার করেন তাতে সংসার চলে যায় কোনওমতে ৷ রাম সাহানির কথায়, "বছর কয়েক আগে বিয়ে করেছি । বাড়িতে আমার স্ত্রী এবং ছোটো ছেলে রয়েছে । দেশের বাড়িতে মা,বাবুজি আর এক বোন রয়েছে । ওদের জন্য আমাকেই টাকা পাঠাতে হয় । তাই অতিরিক্ত কাজ না করলে তা পাঠাব কীভাবে ?"
মাছের বাজারে রামের কাজটাও বড় অদ্ভুত । এন্টালি বাজারের নির্দিষ্ট কোনও মাছ ব্যাপারির কাছে কাজ করেন না তিনি । একটি মাছ আমদানি-রপ্তানি কম্পানির ঠিকে শ্রমিক রাম । কাজটি ঠিক কীরকম? মাছের ব্যাপারিরা মাছ কাটলেই ডাক পড়ে রামের । মাছের মাথার পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে হরমোন বের করে অ্যালকোহলে সংরক্ষিত করে রাখেন । তাঁর সংগ্রহ করা মাছের মুড়োর অংশ অন্ধ্রপ্রদেশের মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠানো হয় । মাছের শরীরে এই হরমোন ইনজেক্ট করা হয় । মাছের বাড়তি উৎপাদনের জন্য দ্রুত প্রজননের কাজে লাগে ৷ ব্যবসাটা মূলত রামের মামার । সেখানে রাম কাজ করে মাত্র । রোজনামচার বর্ণনা দিতে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন বক্সার বলেছেন, "মাছের ব্রেন সংগ্রহ করার জন্য তিন হাজার টাকা পাই । সকালে সাতটার মধ্যে চলে আসি । দুপুর একটা পর্যন্ত এখানে কাজ করে চলে যাই শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে । সেখানে সিভিক পুলিশের কাজ করি । সেখান থেকে মাসের শেষে আট হাজার টাকা বেতন পাই ৷" তাহলে অনুশীলন করেন কখন ? "সকালে সোদপুর থেকে প্রথম ট্রেনে করে শিয়ালদা আসি । সেখান থেকে সাইকেলে আলিপুর বডিগার্ড লাইনে গিয়ে অনুশীলন করি । সেখান থেকে মাছের বাজারে কাজে যোগ দিই ।" লকডাউনের প্রথম দিকে সোদপুর থেকে সাইকেলে করে আসা যাওয়া করছিলেন রাম । কিন্তু বিষয়টি ঝুঁকির বলে এখন বউবাজারে শ্বশুরবাড়িতেই রয়েছেন ।
পটনা থেকে রামের কলকাতায় আসাটাও বড় অদ্ভুত ৷ 1999 সালে মাত্র 9 বছর বয়সে দুর্গাপুজো দেখবেন বলে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন । নিম্নবিত্ত পরিবারের অভাব তাঁকে কলকাতায় তাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল একপ্রকার । উত্তর কলকাতার মুচিপাড়ায় তাঁর মামাবাড়ি । কিন্তু সেখানেও অভাব । তারপর একদিন ঘুড়ি ধরতে ওয়েলিংটনে আসা । ওয়েলিংটনের বক্সিং ক্লাবে বক্সারদের লড়াই দেখে প্রথমেই ভালো লেগে গেছিল । তারপর বক্সিং শেখার জন্য মামার কাছে আবদার । ভাগ্নেকে নিয়ে ওয়েলিংটনে চলে এসেছিলেন রামের মামা । সেই থেকে শুরু । বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট থেকে সিনিয়র পর্যায়ে রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে 16টি পদক জয়ের কৃতিত্ব রয়েছে রাম সাহানির ঝুলিতে । ওয়েলিংটনের বক্সিং ক্লাবে নিয়মিত বক্সিং করেন ।
সমসাময়িক বক্সারদের মধ্যে অনেকেই ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত ৷ "জানেন আমি বিজেন্দর ভাইয়ার (বিজেন্দর সিং) সঙ্গে অনুশীলন করেছি । সেটা 2005 সাল হবে । প্রথম দেখেই বিজুভাই বুঝেছিল আমি বাংলা থেকে গেছি । কত ভালো সময় কাটিয়েছি ওর সঙ্গে । ভারতীয় দলের ক্যাম্পেও ছিলাম । এখন যারা দেশের সেরা বক্সার, সবার সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে । ওদের হারিয়ে পদক জিতেছি আমি ৷" মাথা নিচু করে নিজের বক্সার জীবনের কথা বলে চলছিলেন রাম । সম্পর্ক ভালো থাকলেও লজ্জায় বিজেন্দর সিংকে ফোন করে না । সমসাময়িক একজন বক্সার এখন নৌবাহিনীতে রয়েছেন । মাছের বাজারে কাজ করছেন শুনে দুঃখপ্রকাশ করেছেন ।
শত অভাব সত্ত্বেও স্কুলের গণ্ডি পার করেছেন ৷ নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ সবার কাছে কাজের আবেদন করেছেন । সবাই আশ্বাস দিয়েছেন । কিন্তু কেউ কিছু করেননি বলে অভিযোগ ৷ হাড়ভাঙা পরিশ্রম এবং অনুশীলনের পর ভালো খাওয়াদাওয়া নিতান্তই স্বপ্ন তাঁর কাছে । তাই ঘনঘন চা খেয়ে খিদে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন । বাড়িতে থাকা পদক এবং সার্টিফিকেটগুলো এখন যেন তাঁর দিকে চেয়ে হাসে । রামের কথায়, "ওগুলো এখন শুধুমাত্র কাগজ । পদকগুলো নিয়ে খেলে আমার ছেলে ৷" হতাশা আছড়ে পড়ে এন্টালি বাজারের দেওয়ালে ।
জীবনের রিংয়ে দু'রকমের লড়াই । এত পরিশ্রম, না পাওয়ার যন্ত্রণা সত্ত্বেও বক্সিংকে আঁকড়ে ঘুরে দাঁড়ানোর কথাই শোনা যায় রাম সাহানির মুখে ।