উলুবেড়িয়া, 11 জুলাই : প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার আগে ৷ 2015-র এপ্রিলে মাসুদুর রহমান বৈদ্যের মৃত্যুতে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর ছাত্রী তাহরিনা নাসরিন ৷ পরে বুঝেছিলেন, ইংলিশ চ্যানেল জয় করতে পারলেই গুরুকে আসল শ্রদ্ধা জানানো হবে ৷ ভগ্ন হৃদয়ে জেদ আর ইচ্ছেকে সম্বল করে সেবছরই সফলভাবে ইংলিশ চ্যানেল জয় করেছিলেন প্রয়াত মাসুদুরের ছাত্রী ৷ বছর পাঁচেক পর ফের দূরপাল্লার সাঁতারকে পাখির চোখ করেছিলেন তাহরিনা ৷ ইচ্ছে ছিল জিব্রাল্টার প্রণালী ও নর্থ চ্যানেল জয় ৷ কিন্তু কোরোনা আতঙ্ক তাহরিনার সেই স্বপ্নে ফের ধাক্কা দিয়েছে ৷
বিধিনিষেধ মেনে ক্রিকেট, ফুটবল শুরু হলেও সাঁতার নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি ৷ কারণ সাঁতার, ওয়াটারপোলোর মতো খেলায় কোরোনা সংক্রমণের ভয় সবচেয়ে বেশি ৷ কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা জানা নেই ৷ তবে দূরপাল্লার সাঁতারে নিজের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে তৎপর তাহরিনা নাসরিন ৷ জিব্রাল্টার প্রণালী ও নর্থ চ্যানেল পার হতে গেলে সঠিক অনুশীলনের প্রয়োজন ৷ কিন্তু এইমুহূর্তে সুইমিং পুলগুলি বন্ধ থাকায় ধাক্কা খেয়েছে অনুশীলন ৷ ফিট থাকার জন্য জিমে যাওয়ারও উপায় নেই ৷ তাই বাড়িতেই জিম করে নিজেকে ফিট রাখছেন তাহরিনা ৷ আর অনুশীলনের জন্য বেছে নিয়েছেন বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গাকে ৷ প্রতি সপ্তাহে তিনদিন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা ধরে গঙ্গাবক্ষে অনুশীলন চালাচ্ছেন তাহরিনা ৷
দূরপাল্লার সাঁতার ও প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে তাহরিনের জীবনপঞ্জি যথেষ্ট ঈর্ষণীয়। 2008 সালে ইন্দো-বাংলাদেশ বাংলা গেমসে 50 মিটার ব্যাকস্ট্রোকে রুপো, 100 মিটার ব্যাকস্ট্রোকে ব্রোঞ্জ জেতার পর 100 মিটার রিলেতে সোনা জিতেছিলেন তাহরিনা । 2009 সালে পুনেতে অনুষ্ঠিত স্কুল গেমসে তিনটি রুপো এবং একটি ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন তিনি । ওই বছরই ওড়িশাতে সিনিয়র ন্যাশানাল রিলেতেও সোনা জেতেন । 2010 সালে ফের ইন্দো-বাংলাদেশ বাংলা গেমসে 50 মিটার ব্যাকস্ট্রোকে রুপো পান তাহরিনা । 2017-তে মাস্টার্স করা উলুবেড়িয়ার মেয়েটি ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন । হয়ে ওঠেন বাংলার অন্যতম প্রতিশ্রুতিমান সাঁতারু । স্কুল গেমস, রাজ্য সাঁতার এবং জাতীয় সাঁতারে ভালো পারফরম্যান্সের পাশাপাশি 2012 সালে ইউনিভার্সিটি মিটে দুটো রুপো এবং একটি সোনা জেতেন প্রয়াত মাসুদুর রহমানের বৈদ্যের ছাত্রী ।
2014 সালে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তাহরিনা নাসরিন । সেই বছরই মুর্শিদাবাদের গঙ্গা বক্ষে 81 কিমি সাঁতার প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান তাহারিনার কেরিয়ারের প্রেক্ষাপট বদলে দেয় । মাসদুর রহমান বৈদ্যের উৎসাহ তাঁকে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী করে তোলে । গঙ্গা ও পুরীর সমুদ্রে সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল জয়ের জন্য প্রস্তুত হন । এই প্রস্তুতি পর্বে প্রয়াত মাসদুর রহমান বৈদ্যের সাহায্যের জন্য আজও শ্রদ্ধাশীল তাহরিনা । ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার আগে তাহরিনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা স্যার মাসুদুর রহমানের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়ে যায় তাঁকে ৷ শোক কাটিয়ে সে-বছরই 12 ঘণ্টা 38 মিনিটে ইংলিশ চ্যানেল পার করেছিলেন বছর একুশের মেয়েটি ৷ এছাড়া 2018 সালে সুইম বাংলা চ্যানেল 3 ঘণ্টা 9 মিনিট 58 সেকেন্ড সময়ে অতিক্রম করে রেকর্ড গড়েন । এবার তাঁর চোখ জিব্রাল্টার প্রণালী এবং নর্থ চ্যানেলে । চলতি বছরের এপ্রিল মাসে জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করার কথা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতি সব ভেস্তে গেছে । চ্যানেল জয়ের বিপুল খরচের বোঝা নিয়ে চিন্তা রয়েছে তাঁর । স্পনসরের জন্য নেতা, মন্ত্রীদের দ্বারস্থ হলেও কাজ হয়নি ৷ সব মিলিয়ে বাংলার সাঁতারুর কাছে সময়টা বড্ড কঠিন ৷
কঠিন সময়ে ক্রীড়াবিদদের মানসিক স্থিতি ধরে রাখা কঠিন । স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে তাহরিনা তাই ইতিবাচক চিন্তায় অনুপ্রেরণা খুঁজে চলেছেন ।