আরতি সাহা ( 24 সেপ্টেম্বর 1940- 23 অগাস্ট 1994)
ভারতীয় সাঁতারের গর্বিত অগ্রদূত, আরতি সাহা ইংলিশ চ্যানেল পার করা প্রথম এশিয়ান মহিলা ৷ সময় নিয়েছিলেন 16 ঘণ্টা 20 মিনিট ৷ তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র 19 বছর ৷ নিশ্চিতভাবে এটা তাঁর কেরিয়ারের একটি অভূতপূর্ব মুহূর্ত ৷ তবে শুধু সাঁতার ছাড়াও তাঁর জীবনে আরও অনেক কিছুই আছে ৷ তাঁর গল্পটা উৎসাহের, অধ্যবসায় এবং অবশ্যই ধৈর্যের ৷
প্রথম জীবন
মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে 24 সেপ্টেম্বর 1940 সালে তাঁর জন্ম ৷ মাত্র 2 বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি ৷ ছোটোবেলাতেই সাঁতার শেখা শুরু করেন ৷ তাঁর বাবা পাঁচুগোপাল সাহা ও ভাইয়ের সঙ্গে শহরের চাঁপাতলা ঘাটে স্নানের জন্য যেতেন ৷
পাঁচুগোপালবাবু জলে তাঁর সাহস দেখে অভিভূত হন ও হাটখোলা সাঁতার ক্লাবে তাঁকে ভরতি করে দেন ৷ সেখানেই তিনি প্রথম এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী সচিন নাগের নজরে আসেন ৷ তাঁর গড়া রেকর্ড 3 দশক ধরে অক্ষত ছিল ৷ তবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন দূরপাল্লার সাঁতারুদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ৷ তিনি আরতিকে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন ৷ তাঁর অধীনেই সাঁতারে সেরা প্রশিক্ষণ পান আরতি ৷
সাফল্য
মাত্র পাঁচ বছরের বয়সেই আরতির সাঁতারে কেরিয়ার শুরু হয়ে যায় ৷ তখন পশ্চিমবঙ্গ বঙ্গভঙ্গের কিনারায় দাঁড়িয়েছিল ৷ এবং সাম্প্রদায়িক হিংসা, জোরপূর্বক ধর্মান্তরণ ও মহিলাদের প্রতি পাশবিক অত্যাচার চলছিল তখন অন্যদিকে 1946 সালে শৈলেন্দ্র স্মৃতি সাঁতার প্রতিযোগিতায় 110 গজ ফ্রিস্টাইলে তিনি তাঁর প্রথম সোনা জেতেন ৷ 1946 -56 সালের মধ্যে একাধিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় আরতি অংশ নিয়েছিলেন ৷ 1945- 51 সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যস্তরে 22টি প্রতিযোগিতা জেতেন তিনি ৷ তাঁর প্রধান ইভেন্টগুলি হল 100 মিটার ফ্রিস্টাইল, 100 মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক এবং 200 মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক ৷ মুম্বইয়ের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে 100 মিটার ফ্রিস্টাইল ও 200 মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে রুপো জেতেন ৷ এছাড়া 200 মিটার ফ্রিস্টাইলে ব্রোঞ্জ জেতেন আরতি ৷
কেরিয়ারের সেরা রেকর্ড
জাতীয় ও জেলা স্তরে একাধিক রেকর্ড গড়েন আরতি সাহা ৷ তাঁর রেকর্ডগুলির মধ্যে অন্যতম :-
1949 সালে তিনি অল ইন্ডিয়া রেকর্ড গড়েন ৷ 1951 সালের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মিটে তিনি 100 মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক সম্পন্ন করেন 1 মিনিট 37 সেকেন্ডে ৷ তিনি ডলি নাজিরের অল ইন্ডিয়া রেকর্ড ভাঙেন ৷ তিনি রাজ্য স্তরে 100 মিটার ফ্রিস্টাইল, 200 মিটার ফ্রিস্টাইল ও 100 মিটার ব্যাক স্ট্রোকে রেকর্ড গড়েন ৷
অলিম্পিক : ভারতের প্রতিনিধি
1952 সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে স্বদেশীয় ডলি নাজিরের সঙ্গে ভারহতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন আরতি ৷ সেই অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ভারতীয় দলে চার জন মহিলার মধ্যে তিনিও ছিলেন ৷ এছাড়া ভারতীয়দের মধ্যে সবথেকে কমবয়সি প্রতিযোগী ছিলেন আরতি ৷ অলিম্পিকে 200 মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক ইভেন্টে অংশ নেন তিনি ৷ সাঁতার শেষ করতে তাঁর সময় লাগে 3 মিনিট 40.8 সেকেন্ড ৷ অলিম্পিক থেকে ফিরে তিনি 100 মিটার ফ্রিস্টাইলে তাঁর বোন ভারতী সাহার কাছে হেরে যান ৷
ইংলিশ চ্যানেল জয়
গঙ্গায় দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা দেখে ইংলিশ চ্যানেল পার করার জন্য উদ্বুদ্ধ হন তিনি ৷ প্রথম ভারতীয় হিসেবে ব্রজেন দাসকে দেখেও তিনি উৎসাহিত হন ৷ ব্রজেন দাসের গল্প শোনার পর 19 বছর বয়সে ইংলিশ চ্যানেল পার করার চিন্তা ভাবনা শুরু করেন আরতি ৷ ব্রজেন দাসের মতো মিহির সেনও তাঁকে ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতার কাটার জন্য উৎসাহিত করেন ৷ মিহির সেন অরুণ গুপ্তকে সঙ্গী করে আরতির জন্য ফান্ডা রাইজ়িং ইভেন্টের আয়োজন করেন ৷ তখন তাঁরা তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে পাশে পান ৷ তাঁদের সহযোগিতায় 24 জুলাই 1959 সালে ইংল্যান্ড যান আরতি সাহা ৷
প্রতিযোগিতায় 23টি দেশ থেকে 5 জন মহিলা সহ 58 জন অংশ নেন ৷ প্রতিযোগিতা শুরুর সূচি ছিল 27 অগাস্ট স্থানীয় সময় রাত 1টা ৷ রেসটি ছিল ফ্রান্সের কেপ গ্রিজ় নেজ় থেকে ইংল্যান্ডের স্যান্ডগেট পর্যন্ত ৷ যদিও আরতি সাহার পাইলট বোট সময়ে এসে পৌঁছায়নি ৷ তাই তাঁকে 40 মিনিট দেরি করে শুরু করতে হয় ৷ এবং তিনি প্রতিযোগিতাটি হেরে যান ৷ সকাল 11 টার সময় তিনি 40 মাইলের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেন এবং ইংল্যান্ডের তীর থেকে মাত্র 5 মাইল দূরে ছিলেন ৷ এই সময় তাঁকে বিপরীত দিক থেকে প্রবল ঢেউয়ের সম্মুখীন হতে হয় ৷ ফলস্বরূপ, সন্ধে 8 টায় তিনি মাত্র আরও 2 মাইল বেশি অর্থাৎ মোট 42 মাইল রাস্তা অতিক্রম করেন ৷ যদিও তিনি রেস শেষ করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন ৷ কিন্তু তাঁর পাইলটের চাপে বাধ্য হয়ে তাঁকে হার মানতে হয় ৷
29 সেপ্টেম্বর 1959 সালে তিনি তাঁর দ্বিতীয় প্রচেষ্টা শুরু করেন ৷ ফ্রান্সের কেপ গ্রিজ় নেজ় থেকে শুরু করে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে 16 ঘণ্টা 20 মিনিট সাঁতার কাটার ইংল্যান্ডের স্যান্ডগেটে পৌঁছান ৷ ইংল্যান্ডে পৌঁছে তিনি ভারতের পতাকা হাতে তুলে নেন ৷ এশিয়ার প্রথম মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার করেন তিনি ৷ বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত প্রথম ব্যক্তি যিনি আরতিকে শুভেচ্ছা জানান ৷ তার পর জহওরলাল নেহরু এবং আরও অনেক ব্যক্তিত্ব তাঁকে শুভেচ্ছা জানান ৷ 30 সেপ্টেম্বর অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো তাঁর সাফল্য ঘোষণা করে ৷
প্রথম ক্রীড়াব্যক্তিত্ব যিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার পান
আরতিকে 1960 সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় ৷ দেশের প্রথম ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত হন তিনি ৷ যা দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ পুরস্কার ৷ 1999 সালে ভারতীয় পোস্ট তাঁর সাফল্যকে সম্মানিত করার জন্য 3 টাকার স্ট্যাম্প বাজারে আনে ৷ 1996 সালে তাঁর বাড়ির কাছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় ৷ মূর্তির সামনে 100 মিটারের দীর্ঘ রাস্তা তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়৷
পারিবারিক জীবন
সিটি কলেজ থেকে আরতি তাঁর ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করেন ৷ 1959 সালে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের তত্ত্বাবধানে তিনি তাঁর ম্যানেজার ডাঃ অরুণ গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ৷ প্রথমে তাঁরা কোর্টে বিবাহ করলেও পরে সামাজিকভাবে অনুষ্ঠানও করেন ৷ কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁদের কন্যা অর্চনার জন্ম হয় ৷ আরতি বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়েতে কর্মরত ছিলেন ৷ 1994 সালের 4 অগাস্ট জন্ডিস ও এনসেফ্যালাইটিস নিয়ে তাঁকে 1994 সালের 4 অগাস্ট কলকাতার কাছে একটি নার্সিংহোমে ভরতি করা হয় ৷ 19 দিনের যুদ্ধের পর 23 অগাস্ট শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন আরতি সাহা ৷