কলকাতা, 25 মার্চ : বয়সের ভারে ন্যুব্জ। জীর্ণ শরীরে কথা বলছেন কোনওক্রমে। মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলছেন। মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে গেছে। আর এভাবেই একাকিত্বে দিন কাটছে দু'দুটো সোনার পদক জয়ী হকি অলিম্পিয়ান কেশব দত্তর।
1929 সালে 29 ডিসেম্বর লাহোরে জন্ম। ছোটো থেকেই হকি মন কেড়েছিল কেশব দত্তর। 1947 সালে দেশভাগের খবর যখন পান তখন বোম্বাইতে ইন্টার-প্রভিশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপে খেলছিলেন। মা তাঁকে লাহোরে ফিরতে বারণ করেছিলেন। যদিও টিমমেটরা তাঁকে ফিরতে আশ্বস্ত করছিলেন। অভয় পেয়ে ফিরেছিলেন। কিন্তু, সেখানে দেখেছিলেন শুধু বীভৎসতা। লাহোরের বাতাসে তখন মৃত্যুর ধ্বনি। বাড়ির পর বাড়িতে মানুষের জীবনের লেশমাত্র নেই। লাহোর যেন মৃত্যুকূপ। সেই সময় টিমমেট শাহরুখের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন কেশব দত্ত। কিন্তু, সপ্তাহখানেক পর সে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে সেখান থেকে পালিয়ে যান। লাহোর স্টেশনে তাঁকে ছেড়ে এসেছিলেন শাহরুখ। তবে হকিকে লাহোরে ফেলে আসেননি কেশব।
সালটা 1948। দেশের স্বাধীনতার পর প্রথম অলিম্পিক। 1947 সালের আগে অলিম্পিক হকিতে সোনাজয়ের হ্যাটট্রিক করেছিল ভারত। কিন্তু, দেশভাগের আঁচড়ে ভেঙে গেছিল ভারতের স্বপ্নের দল। শেষপর্যন্ত বহু চেষ্টায় অলিম্পিকে দল পাঠানো হয়। ফাইনালে গ্রেট ব্রিটেনকে 4-0 গোলে হারিয়ে সোনা জেতে স্বাধীন ভারত। দেশভাগের যন্ত্রণায় প্রলেপ দিয়েছিল সোনা। আর সেই দলের সদস্য ছিলেন কেশব দত্ত। টুর্নামেন্টের পাঁচটি ম্যাচেই খেলেছিলেন। হাফ ব্যাক হিসেবে দেশকে ভরসা জুগিয়েছিলেন।
চার বছর পর 1952 সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে বিতর্কের মধ্যে দল পাঠিয়েছিল ভারত। সমস্ত বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখে ফের সোনা জেতে ভারত। তখনও হাফ ব্যাক হিসেবে খেলেছিলেন কেশব দত্ত। টানা পঞ্চমবার সোনা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। মেলবোর্ন 1956 সালের অলিম্পিকে তাঁর অধিনায়ক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, যে কম্পানিতে চাকরি করতেন সেখান থেকে বলা হয়েছিল, ক্যাপ্টেন হলে চাকরি ছাড়তে হবে। সেজন্য অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেননি। তারপর 1972 সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ম্যানেজার হিসেবে ভারতীয় দলের সঙ্গে গেছিলেন।
![Keshav Dutt](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/images/2798247_646_d08e952b-36f0-41b0-b536-8bc2bec744ca.png)
তবে এখন আর কিছুই মনে নেই 94 বছরের কেশব দত্তর। সেই জগত থেকে EM বাইপাসের ধারে একটি অভিজাত কমপ্লেক্সে থাকেন তিনি। আর্থিকভাবে কষ্ট নেই। কিন্তু, একাকিত্ব গ্রাস করেছে। একমাত্র মেয়ে দেশের বাইরে থাকেন। সেখান থেকে নিয়মিত বাবার খবর রাখেন। দেখভালের জন্য দুজন পরিচারক রেখেছেন। তাঁরাই দু'বেলা প্রাক্তন অলিম্পিয়ানের যত্ন নেন।
কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেল, চা খাচ্ছেন প্রাক্তন অলিম্পিয়ান। ঘরে শুধুমাত্র 1948 সালের অলিম্পিকে ভারতীয় দলের একটি গ্রুপ ফটো রয়েছে। ব্যস, এইটুকুই। দুটি অলিম্পিক সোনা জয়ের আর কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই। তা দেখে হকির স্মৃতিচিহ্ন কোথায় জানতে চাইলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। বেশি খানিকক্ষণ পর বলেন, "ঠিক কোথায় রয়েছে মনে নেই।" বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। বয়সের ভারে এখন আর সামনের লনেও যেতে পারেন না। ঘরে বন্ধুরা আসলে গল্প করেন। হাতের কাছে ফোন রয়েছে। তা ঘুরিয়ে মাঝে মাঝে গুরুবক্স সিংয়ের সঙ্গে কথা বলেন।
![Keshav Dutt](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/images/2798247_wb_keshavdut.jpg)
এছাড়া কী করেন কেশববাবু? এক পরিচারক জানান, দিনের বেশিরভাগ সময়টা শুয়ে ঘুমিয়ে কাটে। তবে সকালে উঠে নিয়মিত খুঁটিয়ে কাগজ পড়া চাই। আগে খালি চোখে পড়তে পারলেও এখন আতস কাচ দিয়ে পড়তে হয়। তবে বেশি সময় ধরে পড়তে পারেন না। TVও দেখেন মাঝেমধ্যে। বেশিরভাগ সময়ই অভ্যাবশত চোখ চলে যায় স্পোর্টস চ্যানেলে। হকি হলে তো কথাই নেই। স্মৃতির পাতায় ভাঁজ পড়লেও হাজার হোক দেশের প্রাক্তন অলিম্পিয়ান তো। হকিতেই চোখ আটকে যায় তাঁর। খুঁটিয়ে ম্যাচ দেখেন। ভারতের খেলাও দেখেন। খেলোয়াড় জীবনে যেমন বিপক্ষ দলের স্ট্রাইকারদের বল ছাড়তেন না, তেমনই ভারতের ম্যাচ চললে রিমোট কাউকে দেওয়ার চিন্তা একেবারে নৈব নৈব চ। ফলে বর্তমান ভারতীয় দলের হাল হকিকত জানেন।
হকি নিয়ে প্রশ্ন শুনেও তাই চকচক করে ওঠে কেশব দত্তর চোখমুখ। বলেন, "এখন হকি খেলার ধরন বদলে গেছে। আগের মতো নেই। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নিয়ম পালটে গেছে। আর আগের তুলনায় ভিন্ন ধরনের খেলোয়াড় উঠে আসছেন।" এবার ঘরের মাঠে হকি বিশ্বকাপ ছিল। শুরুটা ভালো করেও ছিটকে যায় ভারত। 1975 সালের পর বিশ্বকাপে আর সোনার স্বাদ পায়নি ভারত। কী বলবেন তা নিয়ে? সে প্রসঙ্গে প্রাক্তন অলিম্পিয়ান যা বললেন তাতে খুব একটা আশার আলো পাওয়া গেল না। তাঁর কথায়, "এই পরিকাঠামোয় ভালো কিছু করা সম্ভব নয়।"
খেলা ছাড়ার পর সেরকম কোনও স্বীকৃতি পাননি। অর্জুনও পাননি। তা নিয়ে ক্ষোভ নেই। অবশ্য থাকলেও প্রকাশ করার মতো স্মৃতিশক্তি নেই। যেটুকু মনে করতে পারেন, তাতে দেওয়ালের দিকে গ্রুপ ফোটোর দিকে তাকান। হয়তো মনে মনে সেই সোনালি বিকেলের স্মৃতি আওড়ান। দরকার কি আর তাঁর দেশের সম্মানের? রক্তক্ষয়ী সময়ে যে মানুষ সোনা জিতে সারা দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন, তাঁর কাছে এর থেকে আর বড় প্রাপ্তি কী বা হতে পারে ?