কলকাতা, 5 অগাস্ট : পানিহাটি বটতলায় আপাত শান্ত পাড়ায় যদি আপনি কোনও বৃদ্ধ গলায় রবীন্দ্র সংগীত শুনতে পান বা রেডিয়োর আওয়াজ পান তাহলে জানবেন তা সনৎ শেঠের । 89 বছরের মানুষটি আজ একা ও ঘরবন্দী । লাল রঙের গেট খুলে বাড়িতে প্রবেশ করলে আগন্তুকের পরিচয় জানার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে সম্ভাষণ করেন ।
একলা ঘরে ছোটো চৌকিতে আবদ্ধ সনৎ শেঠ । আগন্তুকের কুশল বিনিময় ও অতীত স্মৃতির গল্প বলে সময় কাটানোর চেষ্টায় থাকেন । আদুল গায়ে অগোছালো ঘরোয়া পরিবেশে ফুটবলের কথা বলে চলেন । যে শক্তপোক্ত শরীরটা একটা সময় প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকারের পা থেকে অসীম সাহস ও ক্ষিপ্রতায় বল কেড়ে নিত তা এখন কার্যত চলৎশক্তিহীন । ক্রাচে ভর দিয়ে এঘর থেকে ওঘর করেন ঠিকই, কিন্তু খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারেই আটকে পৃথিবী ।
এই বয়সে নিজেকে ফুটবলার বলার চেয়ে মাঠের মালি বলতে ভালোবাসেন । তবে সেটা অভিমানে না বয়সের খেয়ালে তা বোঝা দায় । সম্প্রতি স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে । সেই ক্ষত এখনও দগদগে । ছেলে,বউমা, দুই নাতনির সাহচর্যে দিন কাটে তাঁর । তবুও সনৎ শেঠ একা । অবিন্যস্ত কথায় নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারের সোনালি বিকেল রয়েছে, রয়েছে না পাওয়ার অতৃপ্তি এবং কর্তাদের অবিচারের কথা । তাঁর বয়সি প্রাক্তনরা যখন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানে নিজেদের পারফরমেন্স তুলে ধরতে শ্লাঘা বোধ করেন তখন সনৎ শেঠের গলায় অন্য সুর । লাল-হলুদ জার্সিতে অবসর নিলেও তাঁর অধিক প্রেম রেলওয়ে FC ও এরিয়ানের প্রতি । "রেলওয়ে FC-তে আমার জন্ম । এরিয়ান মামার বাড়ি, ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান আমার মাসি-পিসির বাড়ি ।" বলেই চোখ টিপে মুচকি হাসেন প্রাক্তন তারকা গোলরক্ষক ।
![Sanat Seth](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/4042245_wb_sanathseth2.jpg)
সালটা 1949 । সনৎ শেঠের বয়স মাত্র 19 । উত্তর ২৪ পরগনা জেলা লিগে তখন দাপিয়ে গোলকিপিং করছেন । হঠাৎ একদিন ডাক এল রেলওয়ে FC ফুটবল ক্লাব থেকে । কারণ মোহনবাগানের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ অথচ প্রথম গোলরক্ষক অসুস্থ । দ্বিতীয় গোলরক্ষকের চোট । পরিস্থিতি সামাল দিতে ডাক পড়ে সনৎ শেঠের । পাড়ার পরিচিত ফুটবল কর্তা ফণী ভট্টাচার্যের মাধ্যমে তাঁকে ডেকে পাঠান স্বরাজ ঘোষ । সেই শুরু । তারপর ধীরে ধীরে ময়দানে থিতু হতে থাকলেন পানিহাটির সনৎ । বারের তলায় সনৎ শেঠ থাকা মানে দলের বাকি 10 জন নিশ্চিন্ত । অকুতোভয় সনৎ শেঠ যেন বলের গন্ধ পেতেন । স্ট্রাইকারদের পা বা মাথা থেকে বল দখলে নেওয়াকে সহজাত করে তুলেছিলেন ।
এই সংক্রান্ত আরও খবর : দেশভাগের নির্মমতা থেকে কালজয়ী অলিম্পিয়ান, আজ একাকী কেশব
এভাবেই রেলওয়ে FC-র হয়ে খেলে 1952 সালে এরিয়ানে সই করলেন । ইতিমধ্যে ভারতীয় দলের জার্সিতে প্রতিনিধিত্ব করা হয়ে গেছে । বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি জয় অভ্যাসে পরিণত করেছেন । এরিয়ানে টানা তিন বছর দাপিয়ে খেলার পরে প্রস্তাব এল ইস্টবেঙ্গলের থেকে । সচিব জ্যোতিষ গুহ খেলার কথা বললেন । কিন্তু রাজি হলেও এরিয়ানকে কথা দেওয়ায় সই উইথড্র করে নেন । ইস্টবেঙ্গলে না খেলার মাশুল অন্য ভাবে দিতে হয়ে ছিল সনৎ শেঠকে । 1956 সালের হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ভারতীয় দলের ট্রায়ালে ডাক পাননি । কোচ রহিম সাহেব সনৎ শেঠকে দলে নিতে চাইলেও নির্বাচক প্রধান জ্যোতিষ গুহ তাকে নূ্যনতম সুযোগ দিতে রাজি ছিলেন না ।
1957 সালে কিছুটা দায়ে পড়ে লাল-হলুদ জার্সি চাপান । পরের বছর মোহনবাগানে সই করেন । ছ'বছর সবুজ-মেরুন জার্সিতে দাপিয়ে খেললেও 1963 সালে ফের দলবদল । "ওরা থঙ্গরাজকে পেয়ে আমাকে গুরুত্ব দিতে রাজি হল না ।" অভিমান আজও 90 ছুঁই-ছুঁই মানুষটির গলায় । 1964 সালে ফের এরিয়ানে প্রত্যাবর্তন । 1967 সাল পর্যন্ত ওখানেই খেলেছিলেন । 1968 সালে ফের ইস্টবেঙ্গলে সই করেন ৷ সেখান থেকেই কলকাতা ময়দানকে বিদায় জানান ।
![Sanat Seth](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/4042245_wb_sanathseth.jpg)
ময়দান থেকে সরলেও উত্তর 24 পরগনার হয়ে জেলা লিগে খেলতেন । তারপর কোচিং করিয়েছেন ছোটোদের । খুদে প্রতিভাদের গড়ে তোলার মধ্যে আনন্দ পেয়েছেন । একসময় সেখান থেকেও সরে গেছেন । বছরকয়েক আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেতেন । সেখানেও বঞ্চনা মুখ বুজে সহ্য করতেন । এখন সেইসব আমন্ত্রণ আর আসে না । জন্মদিনে ভালো লাগা বলতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির শুভেচ্ছা চিঠি । ছেলে, বউমা, নাতনিরা নিজের জগতে ব্যস্ত । স্ত্রী কয়েক মাস আগে প্রয়াত । শরীরে থাবা বসিয়েছে বয়স । ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারেন না । হাতের আঙুলের ব্যথা কোনও কিছু আঁকড়ে ধরার পথে অন্তরায় । একসময় বেহালা বাজাতেন । ইচ্ছে হলেও তা আর পারেন না এখন । তাই বেহালার বাক্সে জমেছে ধুলো । সঙ্গী বলতে রেডিয়োর গান ও রবীন্দ্র সংগীত ।
![Sanat Seth](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/4042245_wb_sanathseth1.jpg)