কলকাতা , 22 জুন : করোনা ভাইরাস শুধু আমাদের ঘরবন্দীই করেনি, মাঠে বসে খেলা দেখারও 'প্রতিবন্ধকতা' সৃষ্টি করেছে । যাঁরা খেলার টানে বিশ্বভ্রমণ করেন তাঁদের কাছে করোনার কারণে ইউরোর আসরে অনুপস্থিত থাকা জেলবন্দীর সামিল । গাঁটের কড়ি খরচা করে ফুটবল বিশ্বকাপের আসরে কলকাতার পান্নালাল বাবু এবং তার সহধর্মিনীর উপস্থিত থাকার গল্প অনেকেই শুনেছেন ৷ হুগলির বৈদ্যবাটির বোসপাড়ার পঙ্কজ ঘোষ যেন সেই গল্পের বর্ধিত সংস্করণ । পেশায় স্পোর্টস কাউন্সিলের প্রাক্তন ফুটবল কোচ, বর্তমানে বেসরকারি মিউচুয়াল ফাণ্ড অফিসের কর্মী, নেশায় খেলার দর্শক ।
সত্তর বছরে পা দিতে চলা মানুষটির বিশ্ব ক্রীড়াজগতের বড় আসরে উপস্থিত থাকাই একমাত্র অক্সিজেন । আগামী তিন জুলাই আজারবাইজানের বাকুতে চলতি ইউরো কাপের শেষ আটের খেলা দেখতে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর । খেলা দেখার এবং বিমানের টিকিট পঙ্কজ বাবু 2019 সালের 19 সেপ্টেম্বরেই কেটে রেখেছিলেন । সেই সময় করোনা নামক ভাইরাস সারা বিশ্বে ত্রাস ছড়ায়নি ৷ ফলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি সারতে শুরু করেছিলেন তিনি । শেষ পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ সব আশায় জল ঢেলে দিল ।
" প্রচুর টাকার ক্ষতি হয়ে গেল বুঝলেন । ভেবেছিলাম খেলা মাঠে বসে দেখব । খেলা হচ্ছে অথচ আমি নেই মাঠে এটা ভাবতেই হতাশ লাগছে । আসলে মাঠে বসে বিশ্বকাপ, ইউরো, বা কোপা আমেরিকার খেলা দেখার আনন্দই আলাদা । তার টান উপেক্ষা করা কঠিন । মাঠে গিয়ে গিয়ে এমন হয়েছে যে এবার না যেতে পারাটা আমার কাছে ভীষণ যন্ত্রণার। বিমান ভাড়াটা হয়তো ফেরত পাব, কিন্তু খেলার টিকিটের দামটা পাব না । বাকু থেকে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল ৷", বলছিলেন পঙ্কজ বাবু ।
প্রায় পঁচিশ বছর ধরে খেলা দেখার নেশায় ছুটে বেড়াচ্ছেন বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত । কলকাতার পান্নালাল দাশগুপ্তর কথা জানেন । নামটা শুনতেই বললেন,"পান্নাদা আমাদের সঙ্গেই যেতেন ।" আটাত্তর সাল থেকে টানা 2018 পর্যন্ত মাঠে গিয়ে ফুটবল বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখেছেন প্রয়াত মানুষটি। কিন্তু পঙ্কজ ঘোষ নিজেকে শুধু ফুটবলে আটকে রাখেননি। অলিম্পিক, উইম্বলডন, ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছেন ।
1998 সালে আশি হাজার টাকা ধার করে ফ্রান্সে বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন পঙ্কজবাবু ৷ সেবার দুটো কোয়ার্টার ফাইনাল, একটি সেমিফাইনাল ম্যাচ দেখেছিলেন । ওই সফরে যাওয়ার আগে তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন । পরিচিতদের কাছ থেকে টাকা ধার করে পঙ্কজ ঘোষের ফ্রান্স বিশ্বকাপে যাওয়ার কথা শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন । বলেছিলেন,"আপনার সাহস আছে ।" সেই সাহসে ভর করেই পঙ্কজ ঘোষ বিশ্ব ক্রীড়া জগতের বড়বড় আসরে উপস্থিত থাকতেন ।
1998 থেকে 2018 সাল পর্যন্ত সব কটি ফুটবল বিশ্বকাপের আসরে উপস্থিত থেকেছেন । "1966 সাল থেকে আমি ব্রাজ়িলের সমর্থক । তখন থেকেই মাঠে উপস্থিত থেকে ব্রাজ়িলের বিশ্বজয় দেখার স্বপ্ন ছিল । 2002 সালে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে । 2014 সালে ব্রাজিলে বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছিলাম । সেইজন্য সাত লাখ টাকা ঋণ করেছিলাম । তবে জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রাজিলের ম্যাচে মাঠে ছিলাম না । মাঠে বসে 7-1 গোলে ব্রাজ়িলকে হারতে দেখলে হৃদরোগে আক্রান্ত হতাম ৷", বলছিলেন প্রবীণ মানুষটি ।
রোনাল্ডো-নেইমারের খেলা মাঠে বসে দেখা মানুষটির ঝুলিতে স্প্যানিশ লিগের এল ক্লাসিকো দেখার স্মৃতিও রয়েছে । মাঠে বার্সেলোনার অন্য খেলাও দেখেছেন তিনি । পঙ্কজ ঘোষের এই সফরকে কার্যত স্পোর্টস ট্যুরিজম বলাই যায় । "কথাটার আপত্তি করব না । বিয়ে করিনি । খেলা দেখার নেশায় বিশ্বভ্রমণ হয়ে গিয়েছে । ব্রাজিলে একমাস ছিলাম । আমাজ়ন দেখে এসেছি ৷", বলছিলেন বৈদ্যবাটির মানুষটি ।
ফুটবল মাঠের পাশাপাশি অলিম্পিকের আসরেও সাক্ষী পঙ্কজ ঘোষ । 2008এর বেজিং, 2012 সালের লন্ডনে ভারতের পদক প্রাপ্তির সাক্ষী তিনি । অলিম্পিকের আসরে উসেন বোল্টের দৌড় দেখেছেন দর্শকাসনে বসে । "মাঠে বসে খেলা দেখার অনুভূতি আলাদা । কোনও তুলনা চলে না । 2019 সালে উইম্বলডন এর প্রথম দিনের টিকিট দুই লাখ উনিশ হাজার টাকা দিয়ে কেটেছিলাম । এজেন্ট ধরে কাটতে গিয়ে বেশি খরচ হয়েছিল । জকোভিচ, সেরেনা উইলিয়ামসের খেলা সেন্টার কোর্টে বসে দেখেছি," ঝুলি থেকে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা বের করছিলেন পঙ্কজ ঘোষ ।
কোহলি ধোনিদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের অভিযান 2015 এবং 2019 সালে মাঠে বসে দেখেছেন । "একটা আসর শেষ হলেই পরেরটার জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে হয় । অর্থের যোগান, টিকিট যোগাড়,থাকার ব্যবস্থা এবং দর্শনীয় স্থান ঘিরে একটা ছক কষে পরিকল্পনা করে ফেলি ৷ সেইভাবে জীবন চালাতে হয় আর কী ," বলছিলেন অভিযানের প্রস্তুতির গল্প । ক্রীড়াপ্রেমী ও ভ্রমণ পিপাসু হিসেবে বাঙালির সুনাম বহু প্রাচীন ৷ বৈদ্যবাটির পঙ্কজ ঘোষের এই দুইয়েরই প্রেমিক ৷ তাই অনায়াসেই তাঁকে 'ক্রীড়া পর্যটক' বলাই যায় ৷