সৌমিত্রদাকে কাজের মধ্যে দিয়ে মনে রাখতে চাই । কর্মযোগী ছিলেন । কাজটাই করতে চাইতেন, সেটাই করে গিয়েছেন । কাজের মধ্যে থেকেই নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন । আমিও চাইব, যে মানুষ ওঁকে মনে রাখবে কাজের মধ্যে দিয়ে । আসলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাঁচা শুরু হল 15 নভেম্বর দুপুর 12টা 15 মিনিটের পর থেকে বা সন্ধে সাড়ে 6টার পর থেকে । কেননা, এখন থেকে আরও বেশি করে আমরা তাঁকে মনে করব ।
একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল । আমাদের কারও কিছু করার নেই আর । সৌমিত্রদার থাকাটা খুব দরকার ছিল । এত কাজ তিনি করতেন এই বয়সেও, সারাক্ষণ কাজের মধ্যে থাকতেন । সেই কাজ হয়তো আমাদের আরও সৃষ্টি উপহার দিয়ে যেতে পারত । আমাদের নিজেদেরই অনেক পরিকল্পনা ছিল সৌমিত্রদাকে নিয়ে । সেগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল । আমাদের কাছে একটা বড় ধাক্কা । বাংলা চলচ্চিত্রের কাছে একটা বড় ক্ষতি ।
আমাদের 'বেলাশুরু' ছবিটার শুটিং শেষ হয়ে গিয়েছিল । সেন্সরও হয়ে গিয়েছে । সৌমিত্রদা ছবিটা দেখে যেতে পারলেন না । মুক্তির আগে কলাকুশলীদের সবাইকে ছবিটি দেখাই । সেই স্ক্রিনিংয়ের পরিকল্পনা করেছিলাম 21 মার্চ । লকডাউন হয়ে গেল । কাজেই আমরা ছবিটা দেখাতে পারেনি । যে মানুষটির আদলে বিশ্বনাথ চরিত্রটা তৈরি করা হয়েছিল, তাঁকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে পাশাপাশি দু'জনকে বসিয়ে ছবিটা দেখানোর একটা ইচ্ছে ছিল । সেটা আর হল না ।
যেদিন হলে 100 শতাংশ দর্শক আসতে পারবেন বা আসার মত অবস্থা তৈরি হবে, সেদিনই ছবিটা হলে আসবে । কারণ, সৌমিত্রদার কাজ এবং স্বপ্ন, সেটা পুরো সিনেমা হল গমগম করবে, আমরা শুধু সেই পরিস্থিতির অপেক্ষা করছি । সৌমিত্রদার কাজ দেখার জন্য দর্শক নিজে চলে আসবে ।
যদি ওঁর আদর্শে বিশ্বাস করে থাকি, তাহলে আরও কাজ করে যেতে হবে । নতুন সৃষ্টি করতে হবে । নতুন নতুন সৃষ্টির মন্ত্রতে বিশ্বাস করতেন সৌমিত্রদা । সেটাতে বিশ্বাস রেখে প্রত্যেকদিন অনেক কাজ করতে হবে । জীবনের প্রত্যেক সময়কে একটি মূল্যবান করে তুলতে হবে । সৌমিত্রদার জন্য সেটা তৈরি করব ।
ওঁকে কাজ করতে দেখেছি কাছ থেকে । সৌমিত্রদা নিজের স্ক্রিপ্টের স্ক্রিনিং নিজে করতেন । পেন দিয়ে স্ক্যানিং করে রাখতেন । প্রত্যেকটা সংলাপ মুখস্ত রাখতেন । সেটাই পছন্দ করতেন ।
সত্যি কথা বললে, যে মানুষটা অভিনয় অন্তপ্রাণ, তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে বসলে সিনেমা থেকে বেশি জায়গা পেয়েছে ক্রিকেট । ক্রিকেটের বিরাট বড় ভক্ত ছিলেন । সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে খুব ভালোবাসতেন । আর ডিসেম্বর মানেই প্রচুর জায়গায় ক্রিকেট খেলা হত । যখনই আমরা শুটিং করেছি, সেই সময় টেস্ট ম্যাচ কিংবা শুটিং চলত । সেই নিয়ে আলোচনা প্রতিদিনই হত । সৌরভ গাঙ্গুলি ও বিরাট কোহলিকে পছন্দ করতেন । কিন্তু ওঁর সর্বকালের সেরা ও পছন্দের ক্রিকেটার ছিলেন মনসুর আলি খান পতৌদি । ওঁর পারিবারিক বন্ধু ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর ।
আমাদের সিনেমার অধিকাংশই আউটডোর শুটিং হয়েছে । সৌমিত্রদা আমাদের সঙ্গে থাকতেন । প্রচুর আড্ডা দিতেন । তিনটে সিনেমার তিনটেই শান্তিনিকেতনে হয়েছে । শান্তিনিকেতনে বসে প্রচুর গল্পগুজব হয়েছিল । প্রথমটায় 11 দিন, তার পরেরটায় 13 দিন । আউটডোরে সৌমিত্রদার সঙ্গে থাকার একটা মজা আছে । গান করেছি, কবিতা বলেছি, খাওয়াদাওয়া করেছি, ব়্যাপ আপ পার্টি করেছি শীতকালে । সকলে মিলে একসঙ্গে রান্না-বান্নাতেও অংশ নিয়েছি । এই প্রত্যেকটাই শীতকালে হয়েছে । কাজেই ডিসেম্বরটা খুব মিস করব ।