আজ যে খবর শুনলাম তাতে আমার মন ভেঙে গিয়েছে । এতদিনের একটা সম্পর্ক ছিল আমাদের । পরিবারের একজন ছিলেন । এতদিন ধরে মানুষটাকে দেখছি, এতগুলো ঘটনা ঘটেছে । আজ ভীষণ শূন্যতা গ্রাস করেছে আমাকে ।
এই তো সেইদিনের কথা । ভারত লক্ষ্মীস্টুডিয়োতে নিজের জীবনের উপর তথ্যচিত্রের শুটিং করতে এসেছিলেন পুলুদা (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। সেইদিনের কথা বারবার মনে পড়ছে । এত ভালো দেখেছিলাম লোকটাকে । তারপর চারপাঁচ দিনের মধ্যে কী যে হয়ে গেল । কেউ আমরা কি কল্পনা করতে পেরেছিলাম ? আজ কত কথা স্মৃতির সরণি বেয়ে নেমে আসছে । সব পুরোনো দিনের কথা । ভাবতেই পারছি না মানুষটা আর নেই ।
আমাদের বাড়িতে খুব ঘনঘন আসতেন অপুর সংসারের পর । তারপর বাবার (সত্যজিৎ রায়) সঙ্গে এতগুলো ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে কাজ করতে শুরু করলেন । নিজের পত্রিকা নিয়েও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । সকলেই জানেন সেই পত্রিকার নাম 'এক্ষণ'। সেই পত্রিকা নিয়েও বাবার সঙ্গে আলোচনা করতেন । বাবার অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । যাতায়াত সব শেষ হয়ে গেল ।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ইকুয়েশন ছিল অসাধারণ । বিশেষ কিছু বলতে হত না । বাবার মুখ দেখলেই সৌমিত্রদা বুঝতে পারতেন, বাবা কী চাইছেন । সেখানে কোনওরকমের কোনও অসুবিধে হত না । নিজের প্রত্যেক চরিত্র নিয়ে প্রচুর হোমওয়ার্ক করেছিলেন সৌমিত্রদা । শুধু স্ক্রিপ্ট পড়া নয়, চিত্রনাট্য নিয়ে লেখাপড়া করতেন বিস্তর । একেবারে গভীরে ঢুকে যেতেন ।
তাছাড়া আরেকটা বিরাট গুণ ছিল সৌমিত্রদার । আমি নিজে মানুষ হিসেবে সেই গুণের খুব কদর করি । সেটি হল, সেটে যিনি চা দিতেন, তাঁর সঙ্গেও যেমন ব্যবহার করতেন, বাবার সঙ্গেও তেমনই ব্যবহার করতেন । এবং এই কারণেই প্রত্যেককেই ওঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন ।
বাবার স্ক্রিপ্টের ভাবনায় নিজের অনেক ইনপুট ছিল সৌমিত্রদার । কারণ বাবা যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতেন তাঁকে । বাবা বলেই দিতেন, "তুমি নিজের মতো করে কোরো, না পারলে আমি বলে দেব"। আমার নিজের চোখেই দেখা, সেই দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে । সৌমিত্রদাকে বাবা যেই স্ক্রিপ্ট দিতেন, তাতে প্রচুর নোটস থাকত । শুধু পড়তেন না, রীতিমতো কাজ করতেন । কোথায় থামতে হবে, স্ট্রেস দিতে হবে, কীভাবে বললে জিনিসটা ভালো হয়, যেখানে চা খাবার দৃশ্য, কখন চায়ে চুমুক দিলে ভালো হয়... সবটাই লিখে রাখতেন সেই স্ক্রিপ্টে । সেটা একটা শিক্ষণীয় জিনিস ছিল । এটা সচরাচর এখন আর দেখা যায় না ।
আমার সঙ্গে পুলুদার সখ্যতা ছিল ভীষণ । আমার ছবিতেও কাজ করেছেন, আমার সঙ্গে টেলিভিশনেও কাজ করেছেন, কোথাও কোনও সমস্যা হয়নি । ভীষণ ভালো ছিলেন...আমি বাক্য হারিয়ে ফেলছি বলতে বলতে ।
শেষের দিকে সৌমিত্রদা সকলের সঙ্গে কাজ করতেন । আমার মনে হয়, একজন অভিনেতার সব ধরনের কাজই করা দরকার । অনেক ছবি ভালো হয়নি, কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে কোনওদিন নড়চড় হয়নি । অনেক ছবি হয়ত বসে দেখা যায় না, কিন্তু শুধুমাত্র সৌমিত্রদার জোরে দর্শকের কাছে পৌঁছেছে । না হলে ছবিটা দেখাই যেত না । উনি থাকলে ছবির মান বেড়ে যেত । পরের দিকে ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন, কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন, আবৃত্তি করছিলেন । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কী করতেন না, এটাই হচ্ছে প্রশ্ন । আমার খুব অদ্ভুত লাগত, মানুষটা কত কাজ সুষ্ঠুভাবে করতেন একসঙ্গে । নিজের চেষ্টায় নিজেকে শুধরেছিলেন । 'অপুর সংসার'-এর সময়ে সৌমিত্রদার গলা খুব সরু ছিল । সেটাও নিজের চেষ্টায় নিজের ইচ্ছেতে পালটেছিলেন । খুব সিরিয়াস একজন মানুষ ছিলেন সৌমিত্রদা ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কোনও বিকল্প তৈরি হবে না । এই মানুষটা একমেবাদ্বিতীয়ম ।