পেনসিলভ্যানিয়া, 02 ডিসেম্বর: এক বার, দু’বার তো নয়ই, প্রায় 50 বার বিবর্তিত হয়েছে নোভেল করোনা ভাইরাসের নয়া রূপ ওমিক্রন (COVID Variant Omicron) ৷ আর ভাইরাসের বাইরের দিকে থাকা স্পাইক প্রোটিন বিবর্তিত হয়েছে 32 বার ৷ আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় গোটা দুনিয়া যখন তটস্থ, সেই সময় গবেষণায় উঠে আসা ওমিক্রনের খুঁটিনাটি তুলে ধরলেন পেনসিলভ্যানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় গবেষক সুরেশ ভি কুচিপুড়ি ৷ তিনি জানিয়েছেন, সার্স-কোভ-2 ভাইরাস এখনও পর্যন্ত করোনা যত বার বিবর্তিত হয়েছে, তার মধ্যে ওমিক্রনই সবচেয়ে অস্বাভাবিক ৷
নয় নয় করে 23টি দেশে থাবা বসিয়ে ফেলেছে নোভেল করোনা ভাইরাসের নয়া রূপ ওমিক্রন ৷ এখনও পর্যন্ত করোনার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হিসেবে চিহ্নিত করা গেলেও, ওমিক্রন, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম বি.1.1.529 (COVID Variant B.1.1.529), তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ডেল্টার তুলনায় সেটি কত গুণ বেশি সংক্রামক, তা নিয়ে এখনও অন্ধকারে সাধারণ মানুষ ৷ ভারতেও ওমিক্রনকে নিয়ে আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছে ৷ এমন পরিস্থিতিতে ওমিক্রন নিয়ে এক এক করে সমস্ত কৌতূহলের জবাব দিয়েছেন সুরেশ ৷
করোনার অন্য রূপের চেয়ে ওমিক্রন কতটা আলাদা
সবমিলিয়ে 50 বার চরিত্র বদলেছে ওমিক্রন ৷ সার্স-কোভ-টু (SARS-COV-2) ভাইরাসের বাইরের দিকে হাতলের মতো দেখতে স্পাইক প্রোটিন (Spike Protein Corona) থাকে । শরীরের যে কোষগুলিকে এই ভাইরাস আক্রমণ করে, এই স্পাইক প্রোটিনের সাহায্যে ওই আক্রান্ত কোষগুলিতে আরও নতুন ভাইরাস তৈরি করতে পারে করোনা ভাইরাস । ওমিক্রনের সেই স্পাইক প্রোটিনই 32 বার চরিত্র বদলেছে ৷ সেই তুলনায় ডেল্টা ভাইরাস (COVID Variant Delta) চরিত্র বদলেছিল মাত্র 9 বার ৷ তাই শুধু চরিত্র বদলের নিরিখেই ওমিক্রন নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে ৷ কারণ যত বেশি বার চরিত্র বদল ঘটবে, তত বেশি সংক্রামক হয়ে দাঁড়ায় ভাইরাস ৷ তার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং টিকা, দু’টিকেই ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে তার ৷
দু’বছর হতে চলল, এখনও কোভিডের সার্স-কোভ-2 প্রজাতির নিত্য নতুন রূপ সামনে আসছে কেন
ওমিক্রনের এত বার চরিত্রবদল আশ্চর্যজনক বটে ৷ তবে কোভিডের এত রূপ সামনে আসা একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয় ৷ যে কোনও ভাইরাসই চরিত্রবদল করে ৷ আরএনএ ভাইরাসের চরিত্রবদল অত্যন্ত দ্রুত ঘটে, সার্স-কোভ-2 তার মধ্যেই পড়ে ৷ যত বেশি বার চরিত্রবদল, ততই বেশি দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৷ তাই প্রাণপণ লড়াই ভাইরাসের ৷
বেশি বার চরিত্র বদল হয়েছে বলেই কি ডেল্টার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর ওমিক্রন
এখনও পর্যন্ত কিছুই জানি না আমরা ৷ কোন পরিস্থিতিতে, কী থেকে ভাইরাসের এই নয়ারূপের সৃষ্টি হল, এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার নয় ৷ কিন্তু ওমিক্রনের এত বার চরিত্রবদল এবং এর গঠন অস্বাভাবিক ৷ তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পেয়েছে, এমন রোগীর শরীরেই ভাইরাস দ্রুত চরিত্রবদল করছে ৷ গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আলফার মতো করোনার কিছু রূপ রোগীর শরীর থেকেই মাথা তুলে দাঁড়ায় ৷ কিন্তু একাধিক বার চরিত্রবদলই হোক বা রোগীর শরীরে অবস্থান, ওমিক্রন করোনার অন্য রূপের থেকে আলাদা ৷ হতে পারে, পশুদের শরীর থেকে এই নয়া রূপ ছড়িয়েছে ৷ কারণ শুধু মানুষ নন, বেজি, বাঘ, সিংহ. বিড়াল এবং কুকুরেরও করোনা হতে পারে ৷ এখনও বিশেষজ্ঞদের সিলমোহর না পড়লেও, একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় আমেরিকায় প্রাপ্ত ,সাদা লেজের হরিণের শরীরে সার্স-কোভ-2 মিলেছে । তাই পশুদের শরীরে করোনার নয়া রূপ তৈরি হওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না ।
দুনিয়া জুড়ে ডেল্টা এত ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়াল কী ভাবে
আলফার থেকে ডেল্টা 40 থেকে 60 শতাংশ বেশি সংক্রামক । আবার একদম শুরুতে করোনার যে রূপ চিনে পাওয়া যায়, তার চেয়ে সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ বেশি ছিল । তাই ডেল্টাকেই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ বলে উল্লেখ করেছিলেন বিজ্ঞানীরা । এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, ডেল্টার দ্রুতগতিতে চরিত্রবদল এবং নিজেরই প্রতিরূপ তৈরির ক্ষমতা । শুরুর দিকে যে কয়টি রূপ পাওয়া গিয়েছিল, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভাইরাস পার্টিকল তৈরির ক্ষমতা ছিল ডেল্টার । শুধু তাই নয়, ডেল্টায় যাঁরা সংক্রমিত হয়েছিলেন, তাঁদের থেকেই বেশি ভাইরাস ছড়াচ্ছে । তাই ডেল্টা সংক্রমণ দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছিল ।
এর জন্য ডেল্টার স্পাইক প্রোটিনের একাধিক বার চরিত্রবদলকেই দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা । কারণ বার বার চরিত্রবদলের ফলে অ্যান্টিবডিও ডেল্টাকে কাবু করতে পারছিল না । টিকাও যে ডেল্টার বিরুদ্ধে সে ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি, তা পরীক্ষাতেও প্রমাণিত । শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দেওয়া এবং সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতাই ডেল্টাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল । সমীক্ষাই বলছে, করোনার সূচনাপর্বের তুলনায়, ডেল্টায় আক্রান্তদেরই বেশি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল । এর পিছনে দায়ী ছিল ডেল্টার স্পাইক প্রোটিন পি681R-এর চরিত্রবদল । কোনও রকম সমস্যা তৈরি না করেই সেটি কোষের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারত ।
ওমিক্রন কি ডেল্টাকেও ছাপিয়ে যাবে
এত তাড়াতাড়ি কিছু বলা সম্ভব নয় । চরিত্রবদলে ডেল্টার সঙ্গে এর কিছু মিল যেমন রয়েছে, তেমনই অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আলাদা । তবে 10 বার এমন চরিত্রবদল হয়েছে ওমিক্রনের যেখানে সরাসরি অ্যাঞ্জিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম-2 প্রোটিন ভাইরাসের ACE2 দরজায় টোকা মারে ভাইরাস । ডেল্টার ক্ষেত্রে এমন চরিত্রবদল ঘটেছে মাত্র 2 বার । আবার বার বার চরিত্রবদল যেমন উদ্বেগের, তেমনই এর ফলে ভাইরাসটির অস্থির হয়ে ওঠার সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনই শেষ মেশ তার নিকেশও ঘটতে পারে ।
ওমিক্রনই কি শেষ, নাকি করোনার আরও চরিত্রবদল ঘটবে
ওমিক্রনই শেষ, এমনটা বলা ঠিক নয় । কোভিডের আরও চরিত্রবদল ঘটবে । মানুষ এবং প্রাণীজগতের মধ্যে করোনা যত ছড়াবে, ততই এর বিবর্তন ঘটতে থাকবে । হতে পারে একটা সময় করোনার সঙ্গে থাকতে থাকতে মানবশরীর অভ্যস্ত হয়ে উঠবে । আবার ডেল্টার চেয়েও বেশি সংক্রামক রূপ উঠে আসতে পারে । যেমনটা ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে । তাই টিকাকরণে জোর দেওয়া উচিত । টিকাকরণ যত ধীর গতিতে এগোলে, তত বেশি শরীরে থাবা বসানোর সুযোগ পেয়ে যাবে ভাইরাস । আর যত বেশি ছড়াবে, তত বেশি চরিত্রবদল হবে । তাই আগে টিকাকরণ জরুরি ৷