সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি অনুযায়ী, এপ্রিল-মে মাসে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে, কেন্দ্রীয় সরকার লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য ন্যূনতম মজুরি, পেনশন, স্বাস্থ্য বীমা, মাতৃত্ব সুবিধা এবং ভবিষ্যনিধি তহবিলের মতো সামাজিক সুরক্ষা সুবিধাগুলি চালু করার কথা ভাবছে ।
2020 সালের রূপরেখা মেনেই শ্রমিকদের জন্য এই ধরনের পদক্ষেপ করা হয়েছে । যা প্রতিটি পেশার গিগ এবং প্ল্যাটফর্ম কর্মী-সহ প্রত্যেকের সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাকে সামনে রেখে সম্ভাব্য পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। 2020 সালের রূপরেখা অর্থাৎ সংগঠিত বা অসংগঠিত সেক্টরের সামাজিক নিরাপত্তা বা এসএস কোড অনুযায়ী এই কাজ হচ্ছে। তবে ভারতকে তার প্রতিপক্ষ দেশগুলোর তুলনায় সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা পূরণের উদ্দেশ্য পূরণ করতে অনেক দূর যেতে হবে ।
গত বছরের ডিসেম্বরে, সরকার ঘোষণা করে যে, সারা দেশে 75.8 লক্ষ কর্মচারীর তালিকাভুক্তির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান কর্মসংস্থান প্রণোদনা প্রকল্প, আত্মনির্ভর ভারত রোজগার যোজনা (এবিআরওয়াই) তার প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে । 71.8 লক্ষ কর্মচারীর কোভিড চলাকালীন নতুন চাকরি , পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে তার সাফল্যও প্রদর্শন করছে । এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অরগানাইজেশন (ইপিএফও)-এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত এই স্কিমটি বিভিন্ন শিল্পের নিয়োগকর্তাদের আর্থিক বোঝা হ্রাস করে , তাদের আরও বেশি কর্মী নিয়োগে উৎসাহিত করছে । এবিআরওয়াই-এর অধীনে ভারত সরকার কর্মচারীর অংশ (মজুরির 12%) এবং নিয়োগকর্তার অংশ (মজুরির 12%) প্রদেয় অবদানের দুই বছরের জন্য ক্রেডিট দিচ্ছে বা শুধুমাত্র কর্মচারীর অংশ ইপিএফও নিবন্ধিত কর্মসংস্থান শক্তির উপর নির্ভর করে ।
এবিআরওয়াই-এর অধীনে, ইপিএফও-তে নিবন্ধিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের নতুন কর্মীদের (প্রতি মাসে 15,000 টাকার কম মজুরি) সুবিধাগুলি প্রদান করছে, এই স্কিমের পরিধি এখন 31 মার্চ 2022 পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে৷ 31 মার্চ, 2022 পর্যন্ত নিবন্ধিত সুবিধাভোগীরা নিবন্ধনের তারিখ থেকে দুই বছরের জন্য সুবিধাগুলি পেতে থাকবে ৷ এবিআরওয়াই-এর অধীনে কেন্দ্রীয় সরকার 1.52 লক্ষ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে 60 লক্ষেরও বেশি সুবিধাভোগীকে 10 হাজার কোটি টাকারও বেশি বিতরণ করেছে । উল্লেখযোগ্যভাবে, এই স্কিমটি 194টি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন কৃষি খামার, অটোমোবাইল পরিষেবা, ক্যান্টিন, সাধারণ বীমা, মার্বেল খনি এবং অন্যান্য হাসপাতালে সুবিধা প্রদান করে । তারপরেও অবশ্য এবিআরওয়াই-এর মতো বহুল প্রচারিত স্কিমগুলিও ভারতের কর্মীর 2 শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি ।
অসংগঠিত কর্মীদের প্রতি ভারতের এই অবহেলা দীর্ঘস্থায়ী হলে তা দেশের বিশাল অসংগঠিত সেক্টরের সমন্বয়ে গঠিত দেশীয় কর্ম-কাঠামোর উপর বড় প্রভাব পড়বে। দেশের দারিদ্র্য প্রশমনের ক্ষেত্রেও একটি গুরুতর প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি করবে । ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) অসংগঠিত কর্মীদের সংজ্ঞায়িত করেছে, যার সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগই নেই । ভারতে 47.5 কোটি লোকবলের 91 শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে রয়েছে । বিশ্বব্যাপী 2022 সালে কর্মরতদের মধ্যে 58 শতাংশ অসংগঠিত কর্মসংস্থানে ছিলেন । বিশ্বের একাধিক দেশগুলি সর্বজনীন কভারেজ অর্জন করেছে, যেমন বলিভিয়া, মঙ্গোলিয়া, নামিবিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা । উন্নয়নশীল দেশগুলি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র 7% সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় করে যেখানে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট দেশগুলি প্রায় তিনগুণ এর পিছনে ব্যয় করে ।
বিস্তৃতভাবে, সামাজিক নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে কর্মীদের দুই ধরনের সহায়তা: যারা কাজ করতে অক্ষম বা বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী এবং দরিদ্র বিধবাদের মতো মৌলিক আয় উপার্জন করতে অক্ষম তাদের সামাজিক সহায়তা। দ্বিতীয়ত, সামাজিক বিমায় যাঁরা কাজ করতে সক্ষম কিন্তু যাঁদের নিরাপত্তা স্কিমে খুব কম অ্যাক্সেস রয়েছে যা সাধারণত সংগঠিত খাতে পাওয়া যায় যেমন বার্ধক্য পেনশন, মাতৃত্ব সুবিধা, মৃত্যু এবং অক্ষমতা সুবিধা সহ স্বাস্থ্য কভারেজ ।
আসলে একটি আই ওয়াশ এসএস কোড 2020, যা আটটি বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা আইনকে একত্রিত করে অসংগঠিত কর্মীদের হতাশ করেছে ৷ কারণ সরকারি নীতি আনুষ্ঠানিক উদ্যোগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে বা অসংগঠিতদের অবহেলা করে! বর্তমান কোড সেইসব অসংগঠিত কর্মীদের সম্পর্কে নীরব যারা তাদের জীবিকার সন্ধানে এক পেশা থেকে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হয় । নির্মাণ শ্রমিকরা সর্বদা সাইট থেকে অন্য জায়গায় যান, এমনকী এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যান । তিনি কোথা থেকে নির্মাণ শ্রমিক তহবিলের সুবিধাভোগী?
কর্মীদের সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে কোডটি এন্টারপ্রাইজের আকারের উপর নির্ভর করে । সামাজিক বীমার সর্বজনীন কভারেজ নিশ্চিত করার জন্য ভারতের একটি নির্দিষ্ট নজর থাকা উচিত, তারা যে সেক্টরে কাজ করুক না কেন, কৃষি, উৎপান বা পরিষেবা । দুঃখের বিষয় হল অসংগঠিত শ্রমিক সামাজিক নিরাপত্তা আইন 2008 এবং জাতীয় পেনশন ব্যবস্থা, 2004 থেকে বঞ্চিত। বর্তমান কোডেও, ভারত সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশকে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা থেকে রক্ষা করার একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছে ! কোডের আরেকটি ত্রুটি হল এটি শুধুমাত্র সামাজিক বীমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু সামাজিক সহায়তার ক্ষেত্রে নয় ।
বিভিন্ন ধরণের কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে (উভয় সংগঠিত ও অসংগঠিত বিভাগের অধীনে), তিন শ্রেণীর কর্মী-সুবিধাভোগীদের জন্য একটি সামাজিক বীমা ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব: এক, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা দরিদ্রতমদের জন্য অ-অনুদানকারী । দুই, দরিদ্রসীমার উপরে শ্রমিকদের আংশিক অবদান এবং দরিদ্রসীমার উপরে স্ব-নিযুক্ত (নিয়োগকর্তা); এবং সংগঠিত কর্মীদের জন্য, নিয়োগকর্তা এবং ইপিএফও-এর অধীনে কর্মচারীর অবদান । অর্থনীতিবিদরা (যেমন সন্তোষ মেহরোত্রা এবং জাজতি কেশরী পারিদা) অনুমান করেছেন, জনসংখ্যার সবচেয়ে দরিদ্র 20%-কে কভার করার জন্য মোট খরচ এসেছে 2019-20 সালে 1,37,737 বিলিয়ন টাকা । এটি জিডিপির মাত্র 0.69% পরিমাণের একটি ছোট ভগ্নাংশ হবে । যেহেতু এটি রাজ্য সরকারগুলি সমানভাবে বহন করবে, তাই সমস্ত রাজ্য সরকারের খরচ হবে জিডিপির মাত্র 0.35% । প্রতি বছর 1.50 লক্ষ কোটি টাকা একত্রে, একটি অনুমান অনুসারে, সামাজিক সুরক্ষা এবং কল্যাণে, এই জাতীয় ব্যয়গুলি সমস্তই নাগরিক-কেন্দ্রিক প্রকল্পগুলিতে হবে । তাই, বিশেষ করে অসংগঠিত সেক্টরে কর্মশক্তিকে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি বিস্তৃত আইন প্রণয়নের জন্য ভারতের জন্য এটাই উপযুক্ত সময় ।
রাষ্ট্র সংঘের জনসংখ্যা তহবিল অনুসারে 2050 সালের মধ্যে ভারতের প্রবীণ জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে, শিশুদের সংখ্যাও রেকর্ড বৃদ্ধি পাবে । 60 বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা 2022 সালে 14.9 কোটি থেকে বেড়ে 2050 সালে 34.7 কোটি হবে । এর মানে হল ভারত আগামী 25 বছরে একটি বার্ধক্যবর্ধিত জাতিতে পরিণত হবে।
এদিকে ভারতে বর্তমান সময়ের 90%-র বেশি কর্মশক্তির আজ কোনও সামাজিক নিরাপত্তা নেই । যখন এত বিশাল জনসংখ্যা তাদের অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য সামাজিক সুরক্ষার কোনও সমর্থন ছাড়াই বয়স্ক হয়ে উঠবে, তখন এটি ভারতের জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশকে আরও দারিদ্র্যের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করবে । সরকার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের সামাজিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব স্বীকার না করলে, 2047 সালের মধ্যে দেশ 'ভিক্ষিত ভারত' হিসেবে সামনে আসবে। অমৃত ভারত শুধুই দিবাস্বপ্ন হয়ে থেকে যাবে। সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সামাজিক নিরাপত্তায় বিনিয়োগ।
ডঃ এনভিআর জ্যোতি কুমার
(বাণিজ্যের অধ্যাপক, মিজোরাম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়)