হায়দরাবাদ : হুইল চেয়ারে বসে থাকা সেই মহিলাটিই কি বিজেপির জয় রথ থামিয়ে দিলেন ? নাকি সংখ্যালঘুরা বিশ্বাস করলেন, পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া পার্টি ক্ষমতায় এলে তাদের সমূহ বিপদ । এ কথা বলতেই হবে, সংখ্যালঘুরা বিজেপির রথ থামিয়ে দিল । তারা অন্য যে কোনও বড় ধর্ম নিরপেক্ষ বা অন্য কোনও দলের থেকে তৃণমূল-কংগ্রেসকে বেশি বিশ্বাস করেছে । তাদের সমর্থন করেছে । তাদের ভোট দিয়েছে ।
একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে ক্ষমতায় আসা থেকে আটকাতে পারেন, সে কথা তাঁরা বিশ্বাস করেছেন । আর এই বিশ্বাস থেকে তাদের ভোট জোটবদ্ধ ভাবে গিয়েছে তৃণমূলের খাতায় । এ ছাড়াও বিজেপির বিরুদ্ধে কাজ করেছিল আরও বেশ কিছু কারণ । যেমন, 2019 সালের লোকসভা ভোটের পর তারা জঙ্গলমহল এলাকা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল । জঙ্গলমহলের মহিলা ভোটাররা পুরোপুরি বিজেপিকে অস্বীকার করেছে, তাঁরা একমাত্র অবলম্বন হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বেছে নিয়েছেন । তাদের বিপুল সমর্থন গিয়ে পড়েছে তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কে । এমনকি, মতুয়া ভোট ব্যাঙ্ককে আন্তর্জাতিকরণ করে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করা হলেও তাতে লাভের লাভ কিছু হয়নি ।
এ কথা বলতেই হবে, মমতার এই জয় আসলে রাজ্যের জনগণের রায় । আর সে কারণেই 2016 সালের বিধানসভা নির্বাচনের থেকেও আরও বেশি সংখ্যায় আসন পেয়ে এবার ক্ষমতায় এল তৃণমূল-কংগ্রেস । আর বিজেপি যে বেশি ভোটটা পেয়েছে, সেটা আসলে বাম-কংগ্রেসের ভোট । তাদের ভোটগুলি এসেছে বিজেপির ঘরে । পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র থেকে বাম এবং কংগ্রেস মুছে গিয়েছে ।
কলকাতার দরজাও বিজেপির জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে । যে কলকাতায় তারা ভাল কিছু করবে বলে আশা করেছিল । এমনকি, বিজেপি আশা করেছিল, দলবদলুরা তাদের জন্য অলৌকিক কিছু করে দেখাবেন । কিন্তু, সেই আশাও একেবারে পূরণ হয়নি । তৃণমূল থেকে দল পাল্টে বিজেপিতে যাওয়া বেশির ভাগ বিধায়কই এবারের নির্বাচনে হেরেছেন । এই তালিকায় রয়েছে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈশালী ডালমিয়ার মতো বড় বড় নাম । বঙ্গ বিজেপির বড় নেতা হিসেবে শুভেন্দু অধিকারী নিজেকে কোনও মতে ধরে রাখতে পেরেছেন । কোনও ক্রমে তিনি জয়ী হয়েছেন । পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম আসন থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে পরাজিত করে তৃণমূলকে আটকেছেন তিনি ।
বিজেপির পক্ষে কেরালা কোনও আলাদা গল্প নয় । যেখানে বিজেপি দলটা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে । আগামী পাঁচ বছর তাদের কোনও প্রতিনিধি রাজ্য বিধানসভায় থাকবেন না । উত্তর ও মধ্য কেরলের সংখ্যালঘুরা তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করেছেন এবং এলডিএফ-কে বিশ্বাস করেছেন, তাদের ভোট দিয়েছেন । কারণ, তারা বিশ্বাস করেছেন, গেরুয়া দল ক্ষমতায় এলে তাদের অস্তিত্ব সঙ্কটজনক হয়ে উঠবে । মুসলিম লিগের শক্ত ঘাঁটি উত্তর কেরালায় বামেদের পক্ষেই ভোট গিয়েছে । ঠিক একইভাবে রাজ্যের মধ্য অংশটিতে বসবাস করা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ভোট পেয়েছেন এলডিএফ । তবে দক্ষিণাংশেও ভাল ফল করতে পারেনি বিজেপি । কিন্তু, এই দক্ষিণ অংশটি হিন্দুদের এলাকা বলেই পরিচিত । এখানকার মানুষজনের মন বুঝতে না পারার কারণেই এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হল তারা ।
বংশানুক্রমিক রাজত্ব চালিয়ে যাওয়ার একটি অভিযোগ তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রে বারবার তোলা হয়েছিল । কিন্তু, ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল সেই অভিযোগ ধোপে টিকল না । এবারে ভোটে করুণানিধির দ্বিতীয় প্রজন্ম এম কে স্ট্যালিনই কেবল জেতেননি, করুণানিধির তৃতীয় প্রজন্ম তথা স্ট্যালিনের পুত্র উদয়নিধি স্ট্যালিনও চেপক আসন থেকে বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন । জয়ললিতার জন্য রাজ্যের মহিলা ভোটারদের একটা বড় অংশ এআইএডিএমকে-কে সমর্থন জানিয়ে এসেছিল । কিন্তু, এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে । মহিলা ভোটাররা সমর্থন জানিয়েছেন ডিএমকে-কে ।
দশ বছর এআইএডিএমকে ক্ষমতায় থাকার পর ডিএমকে ক্ষমতায় এল, সরকার বিরোধী হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে, বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা করা ঠিক হবে না । ডিএমকে-এর ক্ষমতায় আসা প্রমাণ করল দলে ক্ষমতার উত্তরাধিকার সুষ্ঠুভাবে চলছে । বহু বছর যুবরাজ থাকার পর, 45 বছরের রাজনৈতিক লড়াই চালানোর পর স্ট্যালিন রাজা হলেন । স্ট্যালিন এমন একটা সময় রাজা হলেন, যখন করোনা ভাইরাসের দাপটে গোটা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ডুবতে বসেছে । রবিবার জয়ের পর দলের মুখপাত্র মানসুন্দরম বলেন, দলের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ । কোথাও কোনও রকম স্বাস্থ্য সঙ্কট দেখা দিলে তার যথাযথ মোকাবিলা করাই এখন একমাত্র অগ্রাধিকার ।
পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালার মত কিন্তু অসমের পরিস্থিতি নয় । এখানে বিজেপির পক্ষে খুশির বাতাবরণ । সংখ্যালঘু ভোট দলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি । আসলে কংগ্রেস আদিবাসীদের নিয়ে যে পরিকল্পনা করেছিল, সেগুলি উল্টে বিজেপির হাতই শক্ত করেছে । সিএএ বিরোধী স্লোগানগুলি কংগ্রেসের মহাজোট বিপিএফ (বোড়োল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট), বাম এবং এআইইউডিএফ কেউ-ই ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারেনি । কারণ এখানে কাজ করেছে হিমন্ত বিশ্বশর্মার চারিত্রিক দৃঢ়তা । তাঁর ব্যক্তিত্ব সবরকম প্ররোচনাকে আটকাতে সক্ষম হয়েছে । অসম চুক্তির ষষ্ঠ ধারার দ্রুত কার্যকর করার কথা বলে বিজেপি আদিবাসীদের পাশে পেয়েছে । আবার বদরুদ্দিন আজমলকে সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে চিত্রিত করেছে । আদিবাসীদের কাছে সব থেকে বড় বিপদ হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে । নির্বাচনে হেরে রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি রিপুন বোরা ইঙ্গিত বলেছেন, জনগণ এই মহাজোটকে একটা 'অপবিত্র জোট' হিসেবে দেখেছে ।
এখন বিজেপির পক্ষে বড় চ্যালেঞ্জ হল মুখ্যমন্ত্রী এবং হেমন্ত বিশ্বশর্মার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা । শান্তি বজায় রেখে পরবর্তী সময়ের জন্য অসমে দীর্ঘ মেয়াদী সরকারের ভিত্তি সুদৃঢ় করা ।
ই পালানিস্বামী এবং ও পনিরসেলভামের মধ্যে লড়াই তামিলনাড়ুতে এআইএডিএমকে দলটাকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে । দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছে এআইএডিএমকে । এই একই ছবি অসমে দেখা যাবে না তো ? না কি গেরুয়া শিবির কোনও একটা সমাধান সূত্র নিঃসন্দেহে বের করে ফেলবে । সর্বানন্দ সোনওয়াল এবং হেমন্ত বিশ্বশর্মার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে দল ।
এর সঙ্গে আরও একটি চমকপ্রদ বিষয় হল অ-বিধায়ক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী ভাবে ছয় মাসের মধ্যে বিধায়ক হয়ে তাঁর মুখ্যমন্ত্রী পদটি ধরে রাখতে পারেন । তিনি কোন এলাকা থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সেটাও দেখার । নির্বাচনের সময় কোভিডে প্রার্থী মারা যাওয়ার কারণে খড়দহ আসনটিতে ফের নির্বাচন হবে । কারণ এই খড়দহ থেকে তৃণমূল জিতেছে । কিন্তু, প্রার্থী করোনায় প্রয়াত হয়েছেন । এখন দেখার এই আসনটি কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য অপেক্ষা করছে । এখান থেকেই কী মমতা বিধায়ক হবেন ?
আরও পড়ুন : 2016-র বিচারে কী হল 2021-এর অঙ্ক ?