হায়দরাবাদ, 1 অক্টোবর: একাধিক কোষ, কলা মিলে তৈরি হয় শরীরের নানা অঙ্গ, তারপর ধীরে ধীরে সেগুলি কীভাবে শরীরের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রাণী দেহে কাজ শুরু করে এবিষয়ে বহু গবেষণা এতদিন হয়েছে বা হচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে ৷ হৃদযন্ত্রের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি আরও জটিল, কারণ এক্ষেত্রে শরীরের এই অঙ্গের সমস্ত কোষকে একসূত্রে বেঁধে ও তাল মিলিয়ে স্পন্দিত হতে হয় ৷
কিন্ত কীভাবে হৃদপিণ্ডের কোষগুলি একসঙ্গে এভাবে স্পন্দিত হয় তার কোনও ছবি বা ঝলক পাওয়া এতদিন সম্ভব হয়নি জীব বিজ্ঞানীদের পক্ষে ৷ কিন্তু এই অধরা বিষয়টিই এবার সামনে আনলেন একদল বিজ্ঞানী ও গবেষক ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নেতৃত্বে চলা একটি গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে এমন কিছু দৃশ্য, যা থেকে দেখে বোঝা সম্ভব ঠিক কীভাবে হৃদযন্ত্রের কোষগুলি এভাবে একসঙ্গে স্পন্দিত হতে শুরু করে ৷
জটিল এই গবেষণা চালানোর জন্য গবেষকরা বেছে নিয়েছিলেন জেব্রাফিসকে ৷ আর এই গবেষণার হাত ধরেই অধরা এই রহস্যের আপাত সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা ৷ পরীক্ষা চলাকালীন হার্ভার্ডের বিজ্ঞানীরা দেখেন, জেব্রাফিসের ভ্রুণের হৃদপিণ্ডের গঠন প্রক্রিয়া চলাকালীন, ক্যালসিয়ামের মাত্রা ও ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনাল একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছানোর পর একসময় হঠাৎই সেখানকার কোষগুলি একসঙ্গে স্পন্দিত হতে শুরু করেছে ৷ আরও দেখা যায়, হৃদপিণ্ডের প্রত্যেকটি কোষ নিজে থেকেই স্পন্দিত হচ্ছে, কোনওরকম পেসমেকারের সাহায্য ছাড়াই এবং এক একটি কোষের এক একটি জায়গায় এই স্পন্দন হচ্ছে ৷ তবে নির্দিষ্ট একটি ছন্দে তাল মিলিয়ে হৃদপিণ্ডের কোষগুলি স্পন্দিত হচ্ছে ৷ গত 27 সেপ্টেম্বরের 'নেচার' পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণার রিপোর্টটি ৷
মনে করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে মানব তথা জীব বিজ্ঞানের নানা গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন পথ দেখাতে পারে এই নতুন আবিষ্কৃত হওয়া তথ্য ৷ এই বিষয়ে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের ব্লাভাটনিক ইন্সটিটিউটের সিস্টেম বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক সিয়ান মেগাসন বলেন, "কীভাবে স্পন্দিত হয় আমাদের হৃদযন্ত্র, দীর্ঘদিন ধরেই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, কিন্তু এই প্রথম আমরা এই প্রক্রিয়ার এত গভীরে গিয়ে বিষয়টিকে এত পরিষ্কারভাবে দেখতে সক্ষম হলাম ৷"
আরও পড়ুন: চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করেনি 'বিক্রম'! বিস্ফোরক দাবি চিনের বিজ্ঞানীর
গবেষেকরা জানিয়েছেন, কীভাবে হৃদযন্ত্রের কোষগুলি স্পন্দিত হতে শুরু করে, তা জানতে তাঁরা এই গবেষণা শুরু করেননি ৷ তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল জেব্রাফিশের মধ্যে কীভাবে কোষগুলি বেড়ে ওঠে ও কোষগুলি কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তা খতিয়ে দেখা ৷ কিন্তু এই পরীক্ষা চালাতে গিয়েই গবেষকদের নজরে আসে হৃদকোষগুলির এভাবে স্পন্দন শুরু করার বিষয়টি ৷ যা ভবিষ্যতে গবেষণার ক্ষেত্রে নয়া দিগন্ত খুলে দিতে পারে ৷
ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন ও হাইস্পিড মাইক্রোস্কোপ ইমেজিং ব্যবহার করে গবেষকরা জেব্রাফিশের ভ্রুণের হৃদযন্ত্রের কোষগুলিতে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ও ইলেকট্রিক্যাল সিগনালের কার্যকারিতা নিয়ে এই গবেষণা চালিয়েছেন ৷ এই গবেষণায় আরও জানা গিয়েছে, হৃদযন্ত্রের একটি অংশে প্রথম স্পন্দন শুরু হয়, তার পর থেকে প্রতিটি স্পন্দনে তৈরি হয় একটি ইলেক্ট্রিক ওয়েভ বা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যা ক্রমাগত হৃদযন্ত্রের কোষগুলির মধ্যে চলতে থাকে ৷ তবে সব জেব্রাফিশের ভ্রুণের হৃদযন্ত্রের একই দিক থেকে এই স্পন্দন শুরু হয়না, ভ্রুণ অনুযায়ী এর তারতম্য হয় ৷ অর্থাৎ এক একটি ভ্রুণে এই স্পন্দনের সূচনা হৃদযন্ত্রের একএক দিক থেকে হয় ৷
গবেষকরা জানিয়েছেন এই গবেষণায় তাঁরা দেখেছেন হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন দিকে এক এক করে স্পন্দন শুরু হয়, পরে তা একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট ছন্দে হৃদস্পন্দন সৃষ্টি করে, সপ্তাহ যত গড়াতে থাকে সেই স্পন্দনের ছন্দ আরও দৃঢ় হয় ৷ এই গবষণা লব্ধ তথ্যের ফলে কীভাবে হৃদস্পন্দন শুরু হয় এই রহস্য থেকে পর্দা উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে ৷
তথ্য বলে, একজন মানুষের শরীরে মোটামুটি 300 কোটি বার হৃদস্পন্দন হয় এবং একবার শুরু হলে আমৃত্যু তা চলতে থাকে ৷ কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের সমস্যার কারণে ঠিকভাবে হৃদস্পন্দন হয়না বা কোনও সমস্যা তৈরি হয় সেক্ষেত্রে কী হয়, কেন এমন হয় ? মনে করা হচ্ছে এই বিষয়েও ভবিষ্যতে আলো ফেলতে পারে এই গবেষণালব্ধ ফল ৷