কলকাতা ও নিউ ইয়র্ক, 11 সেপ্টেম্বর: আরও একবার ফিরে এসেছে সেই ভয়াবহ দিন । আরও একবার স্মরণসভায় জমায়েত করবেন 9/11 হামলায় (9/11 Attack) স্বজনহারারা ৷ সেই 2001 সালের পর থেকেই এটা তাঁদের বাৎসরিক রুটিন ৷ যে মানুষগুলো চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছেন, আরও একবার তাঁদের স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়া যেন ! নবীন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেওয়া, আজ থেকে 21 বছর আগে ঠিক কী ঘটেছিল ! সেদিনের সেই হামলা শুধুমাত্র মার্কিনদের নয়, সারা বিশ্বকেই হতভম্ব করে দিয়েছিল ৷ সেই প্রথমবার আমেরিকা বুঝেছিল, বিশ্বের আর পাঁচটা সন্ত্রাস কবলিত দেশের মতোই তারাও যে কোনও মুহূর্তে আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে ! তারা দুর্ভেদ্য নয় ! দুই দশক পার করা সেই হামলা শুধুমাত্র পেল্লায় দু'টি বহুতলকেই গুঁড়িয়ে দেয়নি, আদতে তা প্রত্যেক মার্কিন নাগরিকের আত্মবিশ্বাসেও আঘাত করেছিল ৷
কেমন ছিল সেই দিনটা ? প্রশ্ন শুনে আজও বিহ্বল হয়ে পড়েন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন গবেষক শঙ্কর চক্রবর্তী ৷ আদতে কলকাতার মানুষ হলেও গত 32 বছর আমেরিকাই তাঁর ঠিকানা ৷ 2001 সালে মায়ামির (Miami) একটি সংস্থায় কর্মরত ছিলেন শঙ্কর ৷ ডিউটি ছিল, সকাল 9টা থেকে বিকেল 5টা পর্যন্ত ৷ কিন্তু, সেদিন আবার অফিসের তরফে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ৷ লোভনীয় পদের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেননি শিকড় ছেড়ে বিদেশে ঘাঁটি গাড়া সেই বাঙালি তরুণ ! তাই নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন কর্মস্থলে ৷
আরও পড়ুন: পুজোর আগে শঙ্কায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা, নজরে রবিবাসরীয় বৈঠক
অফিসের লাউঞ্জে তখন আড্ডা চলছিল ৷ সামনের টেবিলে থরে থরে সাজানো খাবার, সঙ্গে গরম কফি ! লাউঞ্জের এক কোণে রাখা টিভি-টা চলছিল নিজের মতো ৷ হঠাৎই তাতে ফুটে ওঠা একটি দৃশ্য নজর কাড়ে শঙ্করের ৷ তিনি দেখেন, টিভি-তে কোনও একটি খবরের চ্যানেল চলছে ৷ তাতে নিউ ইয়র্ক শহরের (New York City) 'লাইভ টেলিকাস্ট' হচ্ছে ৷ ক্য়ামেরা তাগ করা রয়েছে একটি বিমানে ৷ সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কর নিজের মনেই বিড়বিড় করে ওঠেন, "প্লেনটা এত নীচে দিয়ে কেন উড়ছে ? কী হয়েছে ? কোনও শুটিং চলছে নাকি !" তাঁর মন্তব্য শুনে সহকর্মীরাও টিভি-এর পর্দায় চোখ রাখেন ৷ এর কয়েক মুহূর্তের মধ্য়েই বিমানটি আছড়ে পড়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের (World Trade Center) একটি টাওয়ারে !
ইটিভি ভারতের সঙ্গে আলোচনায় স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে শঙ্কর বলেন, "জানেন, টিভি-তে যখন ওই দৃশ্য দেখলাম, আমরা স্রেফ ভ্য়াবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম ৷ কী ঘটেছে, সেটা বুঝতেই পারছিলাম না ৷ মনে হচ্ছিল, কোনও স্বপ্ন দেখছি !" এরপরই অফিসের লাউঞ্জে রাখা রেডিয়োটি চালানো হয় ৷ তখনই বোঝা যায়, ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গিয়েছে ৷ আমেরিকায়, হ্য়াঁ মহাশক্তিধর আমেরিকার ঘরে ঢুকে হামলা চালিয়েছে বাইরে থেকে আসা সন্ত্রাসবাদীরা ! এই হামলার ঘোর কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় টাওয়ারেও আছড়ে পড়ে আরও একটি বিমান ! চোখের সামনে ধুলোয় মিশে যায় বিরাট স্থাপত্য !
শঙ্কর জানান, সেদিন তাঁদের অফিস তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৷ দুপুর একটার মধ্যেই বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তিনি ৷ তাঁর জন্য দুপুরে পরোটা আর আলু চচ্চড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন কয়েক দিনের জন্য আমেরিকায় বেড়াতে আসা বৃদ্ধা মা ! বাড়ির টিভি-টা অক্লান্ত আপডেট দিয়ে গিয়েছিল দিনভর ৷ বিকেলে রোজের গৃহস্থালীর কেনাকাটাও সেরেছিলেন শঙ্কর ৷ তাঁর অবাক লেগেছিল, এত বড় একটা ঘটনার পরও কী 'শান্ত' আর 'স্বাভাবিক' ছিল মায়ামি ! এর কয়েক বছর পর কাজের সূত্রেই একবার নিউ ইয়র্ক আসতে হয়েছিল শঙ্করকে ৷ হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিলেন অতীত হয়ে যাওয়া ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার চত্বরের ঠিক সামনে ৷ ফাঁকা জায়গাটা দেখে অদ্ভূত একটা অস্বস্তি হচ্ছিল ৷ বেশিক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করেনি ওখানে ৷
আরও পড়ুন: যুবরাজ থেকে রাজা হলেন তৃতীয় চার্লস ! আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিলেন ব্রিটেনের
এরও অনেক পরের ঘটনা ৷ 2011-12 সাল নাগাদ ৷ বিমানে বাল্টিমোর থেকে আটলান্টা যাচ্ছিলেন শঙ্কর ৷ উড়ানে সহযাত্রী এক মহিলার সঙ্গে আলাপ হয় ৷ তিনি জানান, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের হামলা তাঁর দিদি সংসার তছনছ করে দিয়েছে ৷ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁর জামাইবাবু ৷ তাঁর বয়স তখন চল্লিশের কোঠায় ৷ 2001 সালের 11 সেপ্টেম্বর তাঁর দেরিতে অফিস যাওয়ার কথা ছিল ৷ কিন্তু, স্ত্রী জানান, বিকেলে কিছু জরুরি কাজ আছে ৷ তাই একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে ভালো হয় ৷ তাই ওই ব্যক্তি স্থির করেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই অফিস যাবেন ৷ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে প্রথম বিমানটি আছড়ে পড়ার পরই মোবাইলে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি ৷ জানিয়েছিলেন, তাঁরা রয়েছেন অন্য টাওয়ারে ৷ কিন্তু, সেখানে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে ৷ লিফ্ট বন্ধ ৷ তাই তাঁরা অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার চেষ্টা করছেন ৷ কিন্তু, সেদিন আর বাড়ি ফেরা হয়নি শঙ্করের ওই সহযাত্রীর জামাইবাবুর ৷ বস্তুত, তাঁর দেহাবশেষও খুঁজে পাওয়া যায়নি ৷ সেই সময় তাঁর একমাত্র ছেলের বয়স ছিল 14 বছর ৷ আজ সেই কিশোরই 35-এর যুবক ! হয়তো আর কয়েক ঘণ্টা পর গ্রাউন্ড জিরোর অনুষ্ঠানে তিনিও যাবেন সামিল হতে !
2001-এর সেই হামলা আমেরিকায় সামগ্রিক কিছু পরিবর্তন এনেছে ৷ দেশের নিরাপত্তা আগের তুলনায় আরও কঠোর হয়েছে ৷ একইসঙ্গে, বিশেষ একটি সম্প্রদায়কে নিয়ে বেড়েছে উৎকণ্ঠা ৷ আমেরিকা বুঝেছে, পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী দেশেও নিরাপত্তা নিশ্চিত নয় ৷ পরবর্তীতে করোনা অতিমারি মনে করিয়ে দিয়েছে, আদতে মানুষ কতটা তুচ্ছ ! কিন্তু, তারপরও জীবন এগিয়ে চলে ৷ লড়াই জারি থাকে ৷ আমেরিকাও সেভাবেই এগোচ্ছে ৷