ইজিপ্ট, 29 মার্চ: আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহণে বিশ্বের ব্যস্ততম জলপথ হল সুয়েজ খাল ৷ দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো এই খাল লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরকে সংযুক্ত করেছে ৷ তবে গত 23 মার্চ পণ্যবাহী দৈত্যাকার জাহাজ এভার গিভেন সুয়েজে আটকে পড়ার পর থেকেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহলের ৷ এভার গিভেন সুয়েজকে আড়াআড়িভাবে অবরুদ্ধ করে রাখায় তার পেছনে আটকে পড়ে 450-রও বেশি জাহাজ ৷ যা গোটা বিশ্বের কাছে রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷
সুয়েজ সঙ্কট
গত মঙ্গলবার সকালে সুয়েজ খাল দিয়ে ভূমধ্যসাগরের দিকে যাচ্ছিল তাইওয়ানের বিরাট পণ্যবাহী জাহাজ এভার গিভেন। দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছে সুয়েজ। হঠাৎই তীব্র হাওয়ার কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আড়াআড়ি ঘুরে খাল অবরুদ্ধ করে ফেলে কন্টেনার জাহাজটি। এভার গিভেনের পিছনে পরপর দাঁড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশের বহু জাহাজ ৷ অপরিশোধিত তেল থেকে শুরু করে গবাদি পশু-সহ আরও নানা পণ্যবাহী জাহাজ এতদিন ধরে আটকে থাকায় তার তীব্র প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর ৷
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ সুয়েজ খাল ?
জলপথে ইউরোপ থেকে এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ব্যবস্থাকে অনেক সহজ করে তুলেছে সুয়েজ খাল । এই খালের ফলে উত্তর আটলান্টিক থেকে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে দিয়ে অনেক কম সময়ে ভারত মহাসাগরে এসে পৌঁছয় বাণিজ্যিক জাহাজগুলো । সুয়েজ খাল তৈরির আগে আফ্রিকা মহাদেশ বরাবর ঘুরে আসতে জাহাজগুলোকে প্রায় 10 হাজার কিলোমিটার পথ বেশি পাড়ি দিতে হত । সময় লাগত 8 থেকে 10 দিন । এখন তা একদিনেই পেরিয়ে যাওয়া যায় সুয়েজ খালের মাধ্যমে । সুয়েজ খালের দৈর্ঘ্য মাত্র 193 কিলোমিটার। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর ও দক্ষিণে লোহিত সাগরের জলতল সমান হওয়ায় পানামা খালের মতো আলাদা করে জাহাজ পারাপারের জন্য লক ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়েনি । ফলে পানামা খালের চেয়ে অনেক সহজেই জাহাজ যাতায়াত করতে পারে সুয়েজ খালে ।
চিন্তায় বিশ্ব বাণিজ্য
খুব দ্রুত সুয়েজ খাল ফাঁকা না করা গেলে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যে বিরাট ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে । যার প্রভাব পড়তে পারে মধ্যবিত্তের উপর । পণ্যবাহী জাহাজগুলিকে সুয়েজের বিকল্প পথ ধরতে গেলে বাড়বে পরিবহণ খরচ, যার প্রভাব এসে পড়বে সাধারণ মানুষের উপর ৷ মিশরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে রয়েছে এই কৃত্রিম খাল । বিশ্বের প্রায় 90 শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হয়ে থাকে । তার মধ্যে এই খাল দিয়েই 12 শতাংশ বাণিজ্য হয় । সারা বিশ্বের জলপথে বাণিজ্যের 30 শতাংশ শিপিং কনটেইনার এই খাল দিয়েই নিত্য যাতায়াত করে । 2019 সালে এই খাল দিয়ে 19 হাজার জাহাজে 120 কোটি টন পণ্য পরিবহণ করা হয়েছিল । যা সে বছর সমুদ্রপথে বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় আট ভাগের এক ভাগ । গত বছর এসসিএ জানিয়েছিল, 2020 সালে প্রায় 19 হাজার জাহাজ বা প্রতিদিন গড়ে 51.5টি জাহাজ সুয়েজ খাল দিয়ে চলাচল করেছে । শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও চিনের বহু উৎপাদক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যবাহী জাহাজ এই খাল দিয়ে ইউরোপে পাঠায় । আর মধ্যপ্রাচ্যের তেলবাহী জাহাজ ইউরোপে পাঠাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথ । আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী বলা রয়েছে যে, যুদ্ধ বা শান্তি যে কোনও সময় যে কোনও দেশের জাহাজ সুয়েজ খাল ব্যবহার করতে পারবে ।
খাল তৈরির ইতিহাস
1859 সাল থেকে 1869 সাল পর্যন্ত লাগাতার পরিশ্রমের ফলে তৈরি হয়েছিল সুয়েজ খাল । 1869 সালের 17 নভেম্বর এর আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় । মিশরের সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ এই সুয়েজ খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন । তবে 1956 সাল পর্যন্ত এই খালের উপর আধিপত্য বজায় রেখেছিল ফ্রান্স এবং ব্রিটেন । 1956 সালের পর তা পুরোপুরি মিশর সরকারের অধীন হয়ে যায় । 2014 সালে মিশর সরকার খালটির প্রস্থ আরও বাড়ানোর কাজ শুরু করে, যাতে জাহাজ চলাচলের সংখ্যা দৈনিক 49টি থেকে বেড়ে 97টি হয় । এর জন্য খালটির প্রস্থ আরও 35 মিটার বাড়ানো হয়েছে । এই প্রকল্পের আনুমানিক খরচ হয় 5 হাজার 940 কোটি মিশরীয় পাউন্ড । 2016 সালের 24 ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন সুয়েজ খাল চালু হয় ।