নিজেকে নিয়ে ব্রিটিশরা খুব ভালো মজা করতে পারেন ! ব্রিটিশ লেখক অ্যাডরিন গিল বলেছিলেন, "রাজনীতিকদের ঘৃণা করুন । সব রাজনৈতিক নেতাদের । ব্রিটিশ রাজনীতিক নিজেদের অত্যন্ত গুরুত্ব দেন । কিন্তু তাঁরা নিজেদের কাজ কখনই সম্পূর্ণ করেন না ।" ব্রিটেনের বর্তমান পরিস্থিতি এই মজার রহস্য তুলে ধরবে । দশ বছরের মধ্যে চতুর্থবার সাধারণ নির্বাচনের সামনে দেশ । যা কোনওভাবেই তাঁদের ভালো ভাবমূর্তির সঙ্গে মানানসই নয় ।
ব্রেক্সিট নিয়ে 2016 সালের 23 জুন গণভোট হয়েছিল । সেই ভোটে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কনজ়ারভেটিভ দলের টেরেসা মে (650 জনের মধ্যে 330 জন এমপি )-র থেকে সামান্য কিছু আসন কম পেয়েছিলেন ডেভিড ক্যামেরন । এর পরই তিনি পদত্যাগ করেন । ডেভিড ক্যামেরন তাঁর সাম্প্রতিকতম বইতে যাঁরা ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে মত দিয়ে ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন, তাঁদের শুভেচ্ছা জানান । তিনি ফের একবার বলেন, ''ব্রেক্সিটের ফলে দেশ দু'ভাগ হয়ে যাবে, সরকার অকেজো হয়ে পড়বে ।''
ব্রেক্সিটের পক্ষে সায় দিয়ে এক সময় বাহবা কুড়িয়েছিলেন টেরেসা মে । 51 শতাংশের বেশি মানুষ 2016 সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন । কিন্তু, সময় যত এগিয়েছে পরিস্থিতি ততই পালটে গেছে । শুধু জন সমর্থনই নয়, নিজ দল কনজা়রভেটিভ পার্টির শ’খানেক এমপি-ও সমর্থন করেননি প্রধানমন্ত্রী মে-র সেই প্রস্তাব । ভোটাভুটিতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন তিনি ।
ব্রেক্সিট ইশু গোটা দেশের রাজনীতিতে বড়সড় ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে । EU থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা যাঁরা বলতেন, তাঁরা কর্তৃত্ব করার মতো জায়গায় চলে গেছিলেন । তাঁরা মনে করতেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রিটেনের সার্বভৌমত্বকে দখল করার চেষ্টা করছে । যাই হোক স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড তীব্রভাবে ব্রেক্সিট বিরোধী ছিল । ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব তিন
বার দিয়েছিলেন মে, কিন্তু প্রতিবারই তা পার্লামেন্ট প্রত্যাখ্যান করেছিল । বিকল্প আর কিছু না থাকায় এ বছর জুনে পদত্যাগ করেন মে ।
24 জুলাই প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন বরিস জনসন । যিনি নিজে একজন ব্রেক্সিটের কট্টর সমর্থক । ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে বরিস তাঁর 110 পাতার ‘উইথড্রয়াল এগ্রিমেন্ট বিল’ পেশ করেছিলেন । এই বিল-ই আসলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ব্রেক্সিট চুক্তি, যা ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মেনেও নিয়েছে। দীর্ঘ বিলটির কপি সব ব্রিটিশ এমপিকে দেওয়া হয়েছে । ‘মতাদর্শগতভাবে’ (কোনও আলোচনার আগেই) বরিসের বিল মেনে নেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি । বরিসের পক্ষে ভোট পড়ে 329, আর বিপক্ষে 299টি । একই সঙ্গে বরিস চেয়েছিলেন 31 অক্টোবরের মধ্যে পুরো বিষয়টি মধ্যে চূড়ান্ত করতে । কিন্তু, সে সময় বরিসের পক্ষে ভোট পড়ে 308টি, আর বিপক্ষে 322টি । প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের প্রস্তাব মেনে আগামী 12 ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে সম্মতি দেয় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্স । প্রায় 100 বছর পরে বড়দিনের ছুটিতে ভোট হবে এ দেশে । 1923 সালে শেষ বার শীতকালে ভোট হয়েছিল ।
যাই হোক, ব্রেক্সিট নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি কী? ব্রিটিশ রাজনীতেই বা এর প্রভাব কতটা? একটা পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মে 2018 সালের জুলাইতে ভারত সফরকালে । তিনি বলেছিলেন, "আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই । যখন আমরা দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে । ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলে ভারতের সামনে অনেকগুলি সুযোগের দরজা খুলে যাবে ।" শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতীয় ছাত্র ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে কঠোরতা আছে, তা অনেক শিথিল হবে । ব্রিটেনে প্রবেশ এবং চাকরির ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সংখ্যা প্রায় 50 শতাংশ হ্রাস পেয়েছে । 2010-11 সালে যেটা ছিল 39,090 সেটা 2016-17 তে কমে দাঁড়িয়েছে 16,550 তে ।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, কনজ়ারভেটিভরা ভারতের প্রতি অনেক বেশি সহনশীল । প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন তিনবার ( জুলাই 2010, ফেব্রুয়ারি 2013 এবং নভেম্বর 2013 ) ভারত সফর করেছিলেন । লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সামনে (নভেম্বর, 2015 ) ভাষণ দেওয়ার জন্য মোদিকে সঙ্গ দিয়েছিলেন । এ প্রসঙ্গে ক্যামেরন এক বার্তায় বলেছিলেন, মোদিকে এক দিন 10 নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি । প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কথা তুলে ধরে আগামী দিনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের মিলিত ভাবে কাজ করার কথা বলেন তিনি ।
অন্য দিকে আছেন লেবার পার্টির এমপিরা । যেমন লর্ড নাজ়ির আহমেদ, যিনি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের । অভিযোগ, যারা ভারতের ভোট ব্যাঙ্ক রাজনীতির দিকে উসকানি দিয়ে আসছে । ব্রিটেনে বসবাসকারী 1.1 মিলিয়ন ব্রিটিশ-পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের । ইংরাজি ভাষার উপর দক্ষতা ব্রিটেনে তাঁদের চাকরির দরজা খুলে দিয়েছে । ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয়রা বহু কাল ধরে লেবার পার্টিকে সমর্থন করে এসেছেন ।
এ প্রসঙ্গে বলতেই হবে লেবার পার্টির এমপি জেরেমি করবিনের কথা । যাঁকে কাশ্মীর নিয়ে মুখ খুলতেও শোনা গেছে । করবিন কাশ্মীর নিয়ে 25 সেপ্টেম্বর একটি প্রস্তাব এনেছিলেন, যাকে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক পক্ষপাতমূলক বলে মন্তব্য করেছে । লেবার পার্টি পাকিস্তানের মতামত অন্ধভাবে সমর্থন করছে বলেও বিদেশ মন্ত্রকের তরফে বিবৃতি জারি করা হয়েছিল ।
ফিরে আসা যাক আসন্ন নির্বাচনের দিকে । অধিকাংশ জনমত সমীক্ষা বলছে, কনজ়ারভেটিভরা ভালো ফল করবে । বিশেষ করে ব্রেক্সিট এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা তাদের প্রধান ইশু । তবে জনসমর্থন সবসময় দোদুল্যমান এবং জনমত সমীক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল প্রমাণিত হয় । 2015 সালে কনজ়ারভেটিভদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ক্যামেরন, মনে করা হয়েছিল তিনি হেরে যাবেন । কিন্তু, ভোটের ফল অন্যরকম হয়েছিল । তবে একটা বিষয় স্পষ্ট বহু বহু বছর পর একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের সামনে ব্রিটেন ।
বিষ্ণু প্রকাশ
(রাষ্ট্রদূত, লেখক দক্ষিণ কোরিয়া এবং কানাডায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ছিলেন । বর্তমানে বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রতিবেদনের লেখক । )