টোকিও, জাপান, 13 এপ্রিল: ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহৃত লক্ষ লক্ষ টন জল সমুদ্রে ছাড়বার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাপান সরকার ৷ মঙ্গলবার এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চিন একে 'চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীতা' বলে কড়া সমালোচনা করেছে ৷ বিরোধিতা করেছে আঞ্চলিক মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ৷ তবে এই কাজ শুরু করতে বেশ কিছু বছর সময় লাগবে, আর সম্পূর্ণ হতেও কয়েক দশক লাগবে ৷
- ফুকুশিমা দাইচি নিউক্লিয়ার বিপর্যয়
ঠিক দশ বছর আগে 2011 সালের 11 মার্চের ভূমিকম্প আর সুনামিতে তছনছ হয়ে গিয়েছিল জাপান ৷ ওকমা শহরের ফুকুশিমা দাইচি নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের ফিশন রিঅ্যাক্টরগুলো নিজে থেকে বন্ধ হয়ে ডিজেল চালিত জেনারেটর চালু হয়ে গিয়েছিল ৷ রিঅ্যাক্টরগুলোকে ঠান্ডা রাখার পাম্পগুলিকে চালু রাখতে দরকার ছিল বিদ্যুৎ ৷ ফিশন প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় ভেতরে উৎপন্ন বর্জ্যের তাপকে বের করতে এই পদ্ধতি খুব জরুরি ছিল ৷ যদিও সুনামির প্রচণ্ড ঢেউয়ে তিনটি হাইড্রোজেন বিস্ফোরণ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে যাওয়া, নিউক্লিয় বর্জ্য গলে যাওয়ার ঘটনায় 4টে রিঅ্যাকটর বন্ধ হয়ে যায় ৷ দ্রুত খালি করে দেওয়া হয় ওকমা শহর ৷ এমনকি এই সময় আর তারপরেও গলে যাওয়া প্ল্যান্ট থেকে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ মিশ্রিত জল প্রশান্ত মহাসাগরে মিশতে থাকে ৷ পরে একটি প্ল্যান্ট তৈরি করে সেখানে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত জল আটকে রাখার ব্যবস্থা করে জাপান সরকার ৷
- কী বলছে জাপান সরকার?
বিষাক্ত জল ছাড়া নিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহাইদ সুগা জানিয়েছেন, নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের ক্ষয়ের প্রক্রিয়া রুখতে এই জল ছাড়াটা 'অবশ্য প্রয়োজনীয় কাজ' ৷ তবে ট্যাঙ্কের জল পরিশোধন করে তেজস্ক্রিয় পদার্থ দূর করা হয়েছে, তাই জল ছাড়াটা নিরাপদ ৷ আর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি এই জল ছাড়াকে অনুমোদন দিয়েছে ৷
তবে প্রধানমন্ত্রী সুগা আশ্বস্ত করেছেন যে, জলের সুরক্ষা মাত্রা নিশ্চিত করার সঙ্গে বড় রকমের ক্ষতি প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিমাপ করেই জল ছাড়া হবে ৷
- বিষাক্ত জল
নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টগুলি গলে যাওয়ার পর ট্যাঙ্কে জমা জলের পরিমাণ সাড়ে বারো লক্ষ টন ৷ প্ল্যান্ট ঠান্ডা করার জল, বৃষ্টির জল, আর প্রতিদিন মাটিতে মেশা জল মিলিয়ে এই পরিমাণ ৷ প্রতিদিন অ্যাডভ্যান্সড লিকুইড প্রসেসিং সিস্টেম (এএলপিএস) নামক পরিশোধন পদ্ধতির মাধ্যমে নতুন ভাবে দূষিত জল থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ দূর করা হচ্ছে ৷
- আঞ্চলিক মৎস্যজীবীদের বক্তব্য
সমুদ্রে মাছ ধরে দিন চলে যাঁদের, তাঁরা কিন্তু এই ঘটনায় আশঙ্কিত ৷ ফুকুশিমার মৎস্যজীবী কো-অপারেটিভের প্রধান বলেন, ‘'সরকার আমাদের বলেছে যে মৎস্যজীবীদের সমর্থন ছাড়া সমুদ্রে জল ছাড়া হবে না ৷’' প্ল্যান্ট অপারেটর সংস্থা টিইপিসিও-র প্রেসিডেন্ট তোমোয়াকি কোবায়াকাওয়া অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন একতরফা ভাবে জল ছাড়া হবে না এবং বাজে গুজবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ৷
- নানা দেশের প্রতিক্রিয়া
চিনের বিদেশ মন্ত্রী জাপানের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জানিয়েছেন যে, দেশের অভ্যন্তরের কথা না-ভেবে আর বিদেশি দেশগুলিকে ধন্দে রেখে, তাদের বিরোধিতায় এই পদক্ষেপ করতে চলেছে জাপান ৷ এটা দায়িত্বজ্ঞনহীনতার পরিচয়, এর ফলে আন্তজার্তিক স্তরে জনসাধারণের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পড়বে ৷
দক্ষিণ কোরিয়ার বিদেশমন্ত্রীও একে 'সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ৷
তবে জো বাইডেনের মার্কিন স্টেট দপ্তর জাপানকে সমর্থন করেছে ৷ তারা জাপানের এই সিদ্ধান্তকে 'স্বচ্ছ' আখ্যা দিয়েছে ৷ আর নিশ্চয় আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার নিরাপত্তারক্ষাকারী মাত্রাগুলি মেনেই এই ব্যবস্থা করবে তারা, এমনটাই বিশ্বাস মার্কিন সরকারের ৷
আরও পড়ুন : কোভিড 19 অতিমারী শেষ হতে এখনও ঢের দেরি, সতর্ক করল হু
- আইএইএ-র বক্তব্য
- জলকে আরও তরলীকৃত করে অথবা বাষ্পে পরিণত করে ছাড়া হতে পারে, জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থা ৷ এটা নতুন কিছু নয় আর এতে কোনও ভুল নেই ৷ তাই কোনও অপরাধ নয় ৷
- বিশেষজ্ঞদের মত
এই জল ছাড়া নিয়ে দু'ভাগে বিভক্ত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা ৷ অ্যান্টিনিউক্লিয়ার অ্যাক্টিভিস্ট সংস্থা গ্রিনপিস জানিয়েছে, জাপান সরকার আবারও ফুকুশিমার মানুষকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হল ৷ এএলপিএস পরিশোধন পদ্ধতিতে বেশিরভাগ তেজস্ক্রিয় পদার্থ জল থেকে বের করা হলেও ট্রাইটিয়াম-সহ কিছু পদার্থ থেকেই যায় ৷
জাপান সরকারের মুখপাত্র মঙ্গলবার জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে হু-র নিয়ম মেনে আইএইএ-র পর্যবেক্ষণেই জল ছাড়া হবে ৷
তবে বহু বিশেষজ্ঞ আশ্বস্ত করেছেন যে, ওই দূষিত জলকে আরও তরলীকৃত করলে মানুষ-সহ অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে তা ক্ষতিকারক হবে না ৷ জাপানের ওটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ মিছিয়াকি কাইও বলেন, ‘'বিজ্ঞানীরা একমত যে এতে শরীরে ক্ষতির আশঙ্কা খুবই কম ৷’'
তবে ওই অঞ্চলের আইনজীবীরা এই সিদ্ধান্ত এক্ষুণি প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন ৷ তাঁদের কথায়, ‘‘এই জল সমুদ্রে মিশলে আমরা আতঙ্কে ভুগব ৷’'