আমদানিতে শুল্ক কমায় কপালে চিন্তার ভাঁজ পোলট্রি চাষিদের ৷ চিকেন লেগের উপর থেকে আমদানি শুল্ক কমানোর জন্য সরকারের উপর আমেরিকার প্রবল চাপে চিন্তায় দেশের পোলট্রি চাষিরা । সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমেরিকা সফরের সময় এই বিষয়টি নিয়ে বারবার কথা বলতে শোনা গিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে । বিষয়টিকে আমেরিকার আসন্ন নির্বাচনে ইশু করার জন্য তৎপর বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সরকার যদি মার্কিন চাপে আমদানি শুল্ক কমাতে রাজি হয়, তা হলে দেশের পোলট্রি শিল্প কড়া চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে । এই কারণে দেশের পোলট্রি শিল্পের মাথারা সরকারকে বুঝিয়ে চলেছেন, যাতে কোনও ভাবেই মার্কিন চাপে নতিস্বীকার না করা হয় ।
বিশ্বজুড়ে পোলট্রির মাংসের চাহিদা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ায় আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের পোলট্রি শিল্প । এই অবস্থায় অ্যামেরিকা থেকে চিকেন লেগের বিপুল আমদানির খবরে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে পোলট্রি চাষিদের মধ্যে । এই খবর যদি সত্যি হয়, তা হলে পোলট্রির মাংসের দাম কমে যাবে এবং এতে দেশীয় পোলট্রি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে । এই মুহূর্তে পোলট্রি আমদানিতে ভারতে 100 শতাংশ কর দিতে
হয় । আমেরিকা এই পরিমাণ কমিয়ে 30 শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। পোলট্রির মাংসের দাম কমে যাওয়ায় এর আগেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের পোলট্রি শিল্প । ইদানিং পোলট্রির মাংসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা আশার আলো দেখছেন পোলট্রি, সয়াবিন ও ভুট্টা চাষিরা ।
বিদেশি পণ্যের বাজার খুলে দিলে তা বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা । অ্যামেরিকা থেকে চিকেন লেগ আমদানির পিছনে বেশ কিছু আকর্ষণীয় তথ্য রয়েছে । চিকেন লেগ-এর চেয়ে চিকেন পাই (ব্রেস্ট)-তে তুলনামূলক ফ্যাট কম থাকায় আমেরিকানরা চিকেন পাই খাওয়া বেশি পছন্দ করেন । এমনকি বেশিরভাগ খাবারেও চিকেন পাই ব্যবহার করা হয় । তা ছাড়া, আমেরিকানরা ছুড়ি আর ফর্ক দিয়ে খাবার খান । এই পদ্ধতিতে চিকেন লেগ খাওয়াটাও বেশ কষ্টকর । মার্কিন আদবকায়দায় খাবার টেবিলে হাত দিয়ে লেগপিস খাওয়াটাও গ্রহণযোগ্য নয় । এই সব কারণে অ্যামেরিকায় চিকেন লেগের চাহিদা একেবারেই কম । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলি ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয় ।
এতদিন অ্যামেরিকা এই সব চিকেন লেগ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চিন ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে রফতানি করত। কিন্তু ধীরে ধীরে এই সব দেশ পোলট্রির মাংসের ব্যাপারে স্বাবলম্বী হতে শুরু করল। এরপর থেকেই আমেরিকার নজরে আসে ভারতের বিশাল বাজার । চিনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য সম্পর্কে অবনতি এবং চিনে পোলট্রি শিল্পের বিপুল বৃদ্ধিও আমেরিকার নজর ঘোরানোর অন্যতম কারণ। 135কোটি মানুষের বিশাল ভারতীয় বাজার আশার আলো হিসাবে হাজির হয় আমেরিকার কাছে ।
ভারতীয়রা আবার চিকেন লেগ বা চিকেন ড্রামস্টিক (মুরগির থাইয়ের অংশ দিয়ে তৈরি) খেতে বেশি পছন্দ করে । এর ফলে আমেরিকার সামনে নিজেদের দেশে না ব্যবহার হওয়া লেগপিসগুলিকে ভারতের বাজারে বিক্রির সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমেরিকার বাজারে পোলট্রির মাংসের দাম সবচেয়ে কম । তাই সন্দেহাতীতভাবে এই কম দামি সামগ্রী ভারতেও যথেষ্ট কম দামে বিক্রি হবে ।
দেশের গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টের বাজারে পোলট্রি শিল্পের অবদান এক লক্ষ কোটি টাকার। দেশে প্রতি বছর ন’হাজার কোটি টাকার পোলট্রির ডিমের উৎপাদন হয়। চিনের পর বিশ্বে ডিম উৎপাদনে ভারতের স্থান দ্বিতীয়। দেশে বছরে প্রায় 40 কোটি ব্রয়লার মুরগি উৎপন্ন হয়। পোলট্রি শিল্পে বিশ্বে ভারতের স্থান তিন নম্বের (আমেরিকা ও চিনের পরেই) । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) গরিব বাচ্চাদের পুষ্টির জন্য ডিম খেতে বলে।
দেশে জনপ্রতি ডিমের বাৎসরিক চাহিদা 68 এবং মাংসের চাহিদা সাড়ে তিন কিলোগ্রাম, যা ন্যাশনাল নিউট্রিশন অর্গানাইজেশন (NIN)-এর সুপারিশের চেয় অনেকটাই কম । NIN-এর মতে এই দুই চাহিদা হওয়া উচিত যথাক্রমে 180 এবং 11 কিলোগ্রাম । লক্ষ্যপূরণে তাই এই শিল্পের বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রচুর। দেশে প্রায় 40 লক্ষ মানুষ পোলট্রি শিল্পে কাজ করেন । এর সঙ্গে যুক্ত ভুট্টা এবং
সয়াবিন চাষিদের সংখ্যাটাও বিপুল । ভারতে পোলট্রির মুরগির প্রধান খাদ্য ভুট্টা ও সয়াবিন । চাষিরা এই দুই শস্যের চাষ করে মূলত পোলট্রি শিল্পের ভরসাতেই । দেশে উৎপাদিত এই দুই শস্যের অর্ধেক যায় পোলট্রি শিল্পে। সেই কারণে পোলট্রি শিল্প মার খেলে ভুট্টা ও সয়াবিন চাষিরাও ক্ষতির মুখে পড়বেন ।
ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাসে প্রতিনিয়ত বদল ঘটছে । দেশের যুবসমাজ আসক্ত হয়ে পড়ছে পিৎজা, বার্গারের মতো ফাস্ট ফুডে । হোটেলে আমিষ খাওয়ার পরিমাণও বেড়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় অ্যামেরিকার পোলট্রির এ দেশে চাহিদা বাড়তেই পারে । তবে আশার বিষয়, ভারতীয়রা টাটকা খাবারই বেশি পছন্দ করে । পশ্চিমি সংস্কৃতি ব্যাপক ভাবে দেশে ছড়িয়ে পড়লেও খাবারের ব্যপারে ভারতীয়রা এখনও টাটকা সবজি এবং মাংসই পছন্দ করে। আর এই কারণেই দেশের প্রায় প্রতিটা কলোনিতে টাটকা মাংস এবং সবজির বাজার বসে। তাই আমাদের দেশে সংরক্ষিত মুরগির চাহিদা কেমন তা দেখতে হবে ।
আমদানি শুল্ক কমালে দেশের পোলট্রি শিল্প বড় বিপদের মুখে পড়তে পারে বলে সরকারকে সাবধান করছে । এর ফলে একাধিক পোলট্রি খামার ও প্রক্রিয়াকরণ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা । এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলেও আশঙ্কা তাঁদের । দশকের পর দশক ধরে কোনওরকম সরকারি সাহায্য ছাড়াই এগিয়েছে দেশের পোলট্রি শিল্প। আমেরিকার সঙ্গে এই মর্মে চুক্তি হলে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে দেশের পোলট্রি শিল্পে । সরকারকে এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে ।