ম্যানহাটন, 11 সেপ্টেম্বর : সেদিনটা আর দশটা দিনের মতোই ছিল আমেরিকার নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটন সিটি । হঠাৎ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের আকাশ ছোঁয়া কাচের জানালা দিয়ে দেখা যায় বিশালকায় একটি প্লেন ধেয়ে আসছে । সেটি আছড়ে পড়ে টাওয়ারে । কিছুক্ষণ পর আরও একটি বিমান হামলা হয় । প্লেনগুলির আঘাতে টুইন টাওয়ার মাটিতে মিশে যায় । টুইন টাওয়ার ছাড়াও পেন্টাগনেও হামলা হয় সেসময় । জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়দার এই আক্রমণ পুরো বিশ্ব নাড়িয়ে দেয় । বিশ্ব রাজনীতিতে এর তুমুল প্রভাব পড়ে । অভিবাসন বন্ধ, অভিবাসীদের ওপর অত্যাচার, আফগানিস্তানে তালিবান অধ্যুষিত এলাকায় আল কায়দাকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা সহ প্রায় সব দেশেই এই হামলার প্রভাব পড়ে সেসময় ।
হামলার 9 দিন পরেই অ্যামেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ডাক দেন । বিশ্ব রাজনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল অ্যামেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলা । ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের হামলা ছিল অ্যামেরিকার বুকে আঘাত করার মতোই । হামলা চালানোর জন্য দায়ি করা হয় আল-কায়দাকে । এরপর শুরু হয় অ্যামেরিকার সন্ত্রাস দমনের যুদ্ধ । প্রধান টার্গেট ছিল আল-কায়দা
9/11 হামলার চক্রান্তকারী আল কায়দার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করা ও বিচারের আওতায় আনার লক্ষ্যে আফগানিস্তানে সেনা নামায় অ্যামেরিকা । আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে জীবিত অথবা মৃত গ্রেপ্তার করতে চালানো হয় একের পর এক অভিযান । সেই যুদ্ধে অ্যামেরিকার সহযোগিতা করে ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ একাধিক দেশ । শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে লুকিয়ে থাকা লাদেনকে খতম করে চূড়ান্ত জবাব দেয় অ্যামেরিকা ।
তারপর 2003 সালের 21 মার্চ ইরাকে সেনা পাঠান প্রেসিডেন্ট বুশ । তিনি দাবি করেন, CIA ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পেয়েছে । ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেন আল-কায়দাকে সাহায্য করছিলেন । সেখানেও যুদ্ধে অ্যামেরিকা জেতে । সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে চড়ানো হয় । তবে এরপরও সেই অঞ্চলে শান্তি ফেরেনি । সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকে জন্ম হয় জঙ্গি সংগঠন ISIS-এর ।
2001 সালে আফগানিস্তানে অ্যামেরিকার সামরিক অভিযান এবং ক্ষমতা থেকে তালিবানদের অপসারণের পর আল-কায়দার কেন্দ্রীয় কমান্ড ও প্রধান নেতারা হয় মারা যায় অথবা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় । আল-কায়দার বিরুদ্ধে অব্যাহত সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে সংগঠনের দুর্বলতা প্রকাশিত হলেও সাংগঠনিকভাবে আল-কায়দা সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়নি । বরং সংগঠনটি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আজও বিভক্ত হয়ে তাদের কাজ কারবার চালিয়ে যাচ্ছে । বিশেষজ্ঞদের মত, আল-কায়দা পুনর্গঠনে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে 2003 সালে ইরাকে অ্যামেরিকান সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পরবর্তী নৈরাজ্যকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ।
দক্ষিণ এশিয়ায় 9/11 হামলার প্রভাব :
9/11 হামলার পর রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সহযোগিতায় সারা বিশ্ব সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে । সে সময় থেকেই ভারত চেয়েছে যে পাকিস্তানের মাটিতে বেড়ে ওঠা জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে শেষ করা হোক । পাশাপাশি পাকিস্তানের সেনা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভারত বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে নিজেদের দেশের মাটিতে আশ্রয় দেওয়া থেকে নিরস্ত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল সক্রিয় হোক ।
2001 সালে জইশ-ই-মহম্মদের সংসদে হামলার পর ভারত সীমান্তে সেনা মজুত করেছিল এবং মিজ়াইল ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সাজিয়ে ফেলেছিল । পাকিস্তানও সেনা মজুত করেছিল । এদিকে অ্যামেরিকার বুশ প্রশাসন ভেবেছিল এর জেরে পাকিস্তানের নজর আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে পারে । সেরকম হলে তালিবান এবং আল কায়দার বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও ভেবেছিল তারা । ফলে বুশ প্রশাসন দুই দেশের মধ্যেকার পরিস্থিতি সামলাতে উঠে পড়ে লাগে । বাজপেয়ি সরকারের সঙ্গে তড়িঘড়ি কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা শুরু করেন সচিব কলিন পাওয়েল ।
তখন ভারতের কূটনৈতিক চাপের ফলে অ্যামেরিকা ভারতের পক্ষ নেয় । অ্যামেরিকার চাপের মুখে পড়ে তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রপ্রধান মুশারফ 12 জানুয়ারি, 2002-এ ভারতের সংসদ হামলাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ আখ্যা দেন এবং তার সঙ্গে 9/11 হামলার তুলনা করেন । একই সঙ্গে লশকর-ই-তৈবা ও জইশকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।
এদিকে পাকিস্তানকে দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের বন্ধু ভেবে সাহায্য করলেও লাদেনকে খোঁজার বিষয়ে পাকিস্তান বিশেষ সাহায্য করেনি অ্যামেরিকাকে । এর জেরে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের উপর ভরসা হারাতে শুরু করে অ্যামেরিকা । শেষ প্রর্যন্ত লাদেন পাকিস্তানেই লুকিয়ে আছে জানতে পেরে সেখানে সামরিক অভিযান চালায় অ্যামেরিকা । সেখান থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব শুরু হয় । সাম্প্রতিক কালে কাশ্মীর ইশুতেও সেই দূরত্ব দেখেছে বিশ্ব । এক সময়ের বন্ধু অ্যামেরিকাকে কাশ্মীর ইশুতে পাশে পায়নি পাকিস্তান ।