ETV Bharat / international

হোয়াইট হাউজ়ে বিডেন এলে ভারত-চিন নিয়ে অ্যামেরিকার নীতি ফিরে আসবে না - ভারত- চিন নিয়ে অ্যামেরিকার নীতি

ভোটের পূর্বাভাস বলছে, যদি অ্যামেরিকার নির্বাচন এখনই হয়, তাহলে বিডেন জয়ী হবেন ৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন জো বিডেন যদি নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তাহলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বা চিনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধি ও দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের আধিপত্য নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের যে নীতি, তা ফিরিয়ে আনা হবে না ৷ লিখেছেন অরুণিম ভুইঞা ।

Graphical Image
গ্রাফিক্স
author img

By

Published : Aug 10, 2020, 6:27 PM IST

ওয়াশিংটন ও বেজিংয়ের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলাকালীনই ভোটের পূর্বাভাস ও অন্যান্য মডেল অনুমান করছে যে ডেমোক্র্যাট মনোনীত প্রার্থী জো বিডেন এই বছর প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন জিতবেন ৷ এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে ভারত ও অ্যামেরিকার মধ্যে চুক্তিগুলি কোন পথে এগোবে, তা নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছে ৷ এই সমস্ত বিষয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যে পথে এগোচ্ছে, অ্যামেরিকার প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্টের অধীনে আসার পর হোয়াইট হাউজ়ের প্রশাসন সেই পথে না এগোনোর সম্ভাবনাই বেশি ৷ এমনই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা ৷

গত দু'দশক ধরে ভারত ও অ্যামেরিকার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমশ উন্নতির দিকে গিয়েছে ৷ আর চিনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দায়িত্ব নেওয়ার পর যখন থেকে বেজিং বিশ্বের প্রধান শক্তি হওয়ার পথে এগোতে শুরু করেছে, তখন থেকে ওয়াশিংটনের অবস্থান এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী হয়েছে ৷

ভোটের পূর্বাভাস বলছে যে যদি অ্যামেরিকার নির্বাচন এখনই হয়, তাহলে বিডেন জয়ী হবেন ৷ রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিক্সের থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে তৈরি ফিনান্সিয়াল টাইমসের সাম্প্রতিক পোল ট্র্যাকার হল ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বিডেন 538 টির মধ্যে 308 টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পাবেন ৷ ট্রাম্পের মাত্র 113 টি ভোট জোগাড় করতে সক্ষম হবেন ৷ জয়ী প্রার্থীর এই 538 টি ভোটের মধ্যে 270 টি ভোটের প্রয়োজন ৷

এরই মধ্যে ওয়াশিংটন DC-তে অবস্থিত আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক অ্যালান লিখ্টম্যানের পূর্বাভাস হল এই বছরের নির্বাচনে বিডেন জয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন ৷

13 টি ঐতিহাসিক কারণের উপর নির্ভর করে লিখ্টম্যান একটি ‘Keys’ মডেল তৈরি করেছেন ৷ সেই মডেল অনুযায়ী তিনি এই পূর্বাভাস করেছেন ৷ তিনি গত চার দশক ধরে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন ৷ ওপিনিয়ন পোল থেকে একেবারে আলাদা পদ্ধতিতে তৈরি তাঁর ওই মডেলের উপর ভিত্তি করেই তিনি আগের পূর্বাভাসগুলি দিয়েছিলেন ৷

ট্রাম্পের Covid-19 সংকট মোকাবিলা করা এবং নভেম্বরের 3 তারিখের নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার ডাক দেওয়া নিয়ে কড়া সমালোচনার উপর ভিত্তি করেই এই পূর্বাভাস তৈরি হয়েছে ৷ কারণ, পোস্টাল ব্যালটে ভোট হলে তার ফল সঠিক হবে না, এমন ধারণার উপর ভিত্তি করে ভোট পিছিয়ে দেওয়ার ডাক অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের ইতিহাসে নজিরবিহীন ৷

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন জো বিডেন যদি নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তাহলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বা চিনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধি ও দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের আধিপত্য নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের যে নীতি, তা ফিরিয়ে আনা হবে না ৷

বিদেশ মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী ETV ভারত-কে বলেন, “ভারত ও অ্যামেরিকার মধ্যে সম্পর্ক একটি নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছে গিয়েছে ৷”

ভারত ও অ্যামেরিকা একে অপরের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী কৌশলগত অংশীদারিত্ব ভাগ করে নেয় ৷ যার ফলে দুই দেশই দ্বিদলীয় সমর্থন উপভোগ করে ৷

অ্যামেরিকা ভারতকে তাদের অন্যতম প্রতিরক্ষা সহযোগীর জায়গা দিয়েছে ৷ ওয়াশিংটনের নিকটতম প্রতিরক্ষা এবং কূটনৈতিক সহযোগীদের সঙ্গে সমানভাবে দিল্লিকেও নিয়ে এসেছে ৷

US ইন্ডিয়া পলিটিকাল অ্যাকশন কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রবিন্দর সচদেবের মতে বিডেন যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলেও দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তিগুলি একই পথে এগিয়ে যাবে ৷ কারণ, “বিস্তৃত ও গভীরতর ভারত-মার্কিন সম্পর্ক একটা নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছে গিয়েছে ৷ সেখান থেকে সম্পর্ক আশা করা হচ্ছে যে সামনের দিকেই এগোবে ৷”

সচদেব বলেন, “সামনের দিকে এগোনোর এই পথ কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে ৷ আপনি নিশ্চয় জানেন যে কিছু প্রশাসনের ক্ষেত্রে তার গতি বৃদ্ধি পায় ৷ আবার কিছু প্রশাসনে একই রকম গতিতে চলতে থাকে ৷ কিন্তু মারাত্মক গতি ও গভীরতার সঙ্গে এগোয় না ৷”

তবে একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন যে এটাও মনে রাখা দরকার যে একই সময়ে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চ ও নিম্ন, দুই কক্ষেই নির্বাচন রয়েছে ৷ যখন নিম্নকক্ষ হাউজ় অফ রিপ্রেজ়েন্টেটিভ ডেমোক্র্যাটরা নিয়ন্ত্রণ করেছে, তখন সেনেটে নিয়ন্ত্রণ ছিল রিপাবলিকানদের ৷

সচদেব বলেন, “যদি সেনেটে ডেমোক্র্যাটরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ফিরে আসে এবং বিডেন হোয়াইট হাউজ়ে থাকেন ৷ তখন আমি মনে করি মার্কন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক সরল পথ এগিয়ে যাবে ৷ কারণ, এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা ভারতের সমালোচনা করে ৷ আর হাউজ় ও সেনেট নিয়ন্ত্রণ করলে, সেটা করতে তাদের সুবিধাই হবে ৷”

“মনে রাখতে হবে যে মার্কিন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টই সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হন ৷ কিন্তু হাউজ় ও সেনেটের একসঙ্গে কিছু ক্ষমতা থাকে ৷ তারা অনেক কিছু করতে পারে ৷ তারা অনেক শর্ত আরোপ করতে পারে ৷ তারা বিল আনতে পারে ৷ কোনও বিল নিয়ে সংশোধনী বা রেজ়োলিশনও আনতে পারে ৷”

অ্যামেরিকা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চায় ৷ যা স্বচ্ছ এবং বিপরীতমুখী ৷ 2019 সালে পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য 149 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল ৷ অ্যামেরিকার তরফে করা শক্তি সংক্রান্ত রপ্তানি এই বাণিজ্য সম্পর্কের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়েছিল ৷

যদি বিডেন হোয়াইট হাউজ়ে প্রবেশ করেন, তাহলে অ্যামেরিকার সঙ্গে চিনের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে জল্পনা চলছে ৷

Covid-19 প্যানডেমিক যা চিনের উহান শহর থেকে ছড়িয়েছে, তা চিনের সঙ্গে অ্যামেরিকার সম্পর্কের বর্তমান অবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ৷ পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর মতে, এই অবস্থান থেকে বিডেন সরে আসতে পারবেন না ৷

এছাড়া অ্যামেরিকা ও চিনের মধ্যে অর্থনৈতিক বিবাদ চলছে ৷ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চিনের বিরুদ্ধে কিছু ট্যারিফ ও বাণিজ্য প্রতিরোধ তৈরি করার পর এই বিরোধ শুরু হয় ৷ এটাকে পরিবর্তন করাই আসল লক্ষ্য ৷ কারণ, ওয়াশিংটন এটাকে ‘অনুচিত বাণিজ্য অভ্যাস’ বলছে ৷ এই ধরনের বাণিজ্য অভ্যাস ও তার প্রভাবের মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি চুরি এবং মার্কিন প্রযুক্তিকে চিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ৷

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “এখন চিন কৌশলগত চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠেছে এবং বিডেন এটাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না ৷”

প্রাক্তন এই কূটনীতিক উল্লেখ করেছেন যে প্যানডেমিকের আড়ালে চিন কিছু পদক্ষেপ করেছে ৷ “কিন্তু বিস্তারিত ভাবে মার্কিন নীতি এখনও গ্রহণ করা হয়নি ৷”

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, যা জাপানের পূর্ব উপকূল থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত, সেখানে বেজিংয়ের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা অ্যামেরিকা ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আরও একটা কারণ ৷

বেজিংয়ের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ তুলে ওই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা তৈরি করার জন্য ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চতুর্দেশীয় জোট তৈরি করে কাজ করছে ৷

এছাড়া দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে চিনের অনড় মনোভাব এবং কিছু দেশের সঙ্গে এলাকা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে ৷

2017 সালে যে অ্যামেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে চিনকে ‘সংশোধনবাদী শক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ৷ সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে চক্রবর্তী জানিয়েছেন যে দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতি বদল করে দিয়েছেন ট্রাম্প ৷ আর এখন ইউনাইটেড নেশন কনভেনশন অন দা ল অফ দা সি (UNCLOS)-কে সমর্থনও করছে ৷

তিনি বলেন, “এই চতুর্দেশীয় জোট (ভারত, অ্যামেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া) আরও এগিয়ে যাবে ৷ আর চিন প্রতিবাদ করবে ৷”

সচদেবের মতে চিন নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান এবং বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও তীব্র ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে ৷

তিনি বলেন, “নভেম্বরের মধ্যে এর জন্য বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে বদলে যাবে ৷”

“কারণ, আপনি দেখবেন যে যখন আপনি কোনও রাস্তা ধরে এগিয়ে যান, তখন ফিরে আসা কার্যত অসম্ভব হয়ে যায় ৷ যেই শাসক হোন, যেই প্রেসিডেন্ট পদে বসুন, তিনি ট্রাম্প হোন কিংবা বিডেন, আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে তিনি চিন-বিরোধী নীতি এগিয়ে নিয়ে যাবেন ৷”

সচদেব জানিয়েছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে 2050 বা 2060 সালের মধ্যে চিন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি অথবা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সর্ব-শক্তিমান হয়ে উঠতে পারে ৷ অতীতের সর্ব-শক্তিমান হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রক্রিয়াকে আরও পিছিয়ে দিতে চাইছে ৷

তিনি বলেন, “এখন, ট্রাম্প প্রশাসনের সময় আমেরিকা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে চিনের এই উত্থানকে পিছিয়ে দিলে হবে না ৷ বরং আমাদের এই উত্থানকে থামিয়ে দিতে হবে ৷ যাতে চিন আর কখনওই এক নম্বর হয়ে উঠতে না পারে ৷”

“সুতরাং, এটা অনেক বড় লড়াই, যা চিনের বিরুদ্ধে শুরু করেছেন ট্রাম্প ৷ এখন, যদি বিডেনের প্রশাসন ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা কম বেশি একই পথে চলবে বলেই আশা করা যায় ৷ কারণ, একবার যখন অ্যামেরিকা এই বিষয়টিতে নিশ্চিত হয়েছে যে আমাদের চিনকে এক নম্বর হওয়া থেকে পিছিয়ে দিলে হবে না ৷ বরং থামিয়ে দিতে হবে ৷ তখন এই পথেই সবটা এগোবে ৷”

ওয়াশিংটন ও বেজিংয়ের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলাকালীনই ভোটের পূর্বাভাস ও অন্যান্য মডেল অনুমান করছে যে ডেমোক্র্যাট মনোনীত প্রার্থী জো বিডেন এই বছর প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন জিতবেন ৷ এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে ভারত ও অ্যামেরিকার মধ্যে চুক্তিগুলি কোন পথে এগোবে, তা নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছে ৷ এই সমস্ত বিষয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যে পথে এগোচ্ছে, অ্যামেরিকার প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্টের অধীনে আসার পর হোয়াইট হাউজ়ের প্রশাসন সেই পথে না এগোনোর সম্ভাবনাই বেশি ৷ এমনই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা ৷

গত দু'দশক ধরে ভারত ও অ্যামেরিকার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমশ উন্নতির দিকে গিয়েছে ৷ আর চিনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দায়িত্ব নেওয়ার পর যখন থেকে বেজিং বিশ্বের প্রধান শক্তি হওয়ার পথে এগোতে শুরু করেছে, তখন থেকে ওয়াশিংটনের অবস্থান এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী হয়েছে ৷

ভোটের পূর্বাভাস বলছে যে যদি অ্যামেরিকার নির্বাচন এখনই হয়, তাহলে বিডেন জয়ী হবেন ৷ রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিক্সের থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে তৈরি ফিনান্সিয়াল টাইমসের সাম্প্রতিক পোল ট্র্যাকার হল ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বিডেন 538 টির মধ্যে 308 টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পাবেন ৷ ট্রাম্পের মাত্র 113 টি ভোট জোগাড় করতে সক্ষম হবেন ৷ জয়ী প্রার্থীর এই 538 টি ভোটের মধ্যে 270 টি ভোটের প্রয়োজন ৷

এরই মধ্যে ওয়াশিংটন DC-তে অবস্থিত আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক অ্যালান লিখ্টম্যানের পূর্বাভাস হল এই বছরের নির্বাচনে বিডেন জয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন ৷

13 টি ঐতিহাসিক কারণের উপর নির্ভর করে লিখ্টম্যান একটি ‘Keys’ মডেল তৈরি করেছেন ৷ সেই মডেল অনুযায়ী তিনি এই পূর্বাভাস করেছেন ৷ তিনি গত চার দশক ধরে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন ৷ ওপিনিয়ন পোল থেকে একেবারে আলাদা পদ্ধতিতে তৈরি তাঁর ওই মডেলের উপর ভিত্তি করেই তিনি আগের পূর্বাভাসগুলি দিয়েছিলেন ৷

ট্রাম্পের Covid-19 সংকট মোকাবিলা করা এবং নভেম্বরের 3 তারিখের নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার ডাক দেওয়া নিয়ে কড়া সমালোচনার উপর ভিত্তি করেই এই পূর্বাভাস তৈরি হয়েছে ৷ কারণ, পোস্টাল ব্যালটে ভোট হলে তার ফল সঠিক হবে না, এমন ধারণার উপর ভিত্তি করে ভোট পিছিয়ে দেওয়ার ডাক অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের ইতিহাসে নজিরবিহীন ৷

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন জো বিডেন যদি নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তাহলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বা চিনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধি ও দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের আধিপত্য নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের যে নীতি, তা ফিরিয়ে আনা হবে না ৷

বিদেশ মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী ETV ভারত-কে বলেন, “ভারত ও অ্যামেরিকার মধ্যে সম্পর্ক একটি নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছে গিয়েছে ৷”

ভারত ও অ্যামেরিকা একে অপরের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী কৌশলগত অংশীদারিত্ব ভাগ করে নেয় ৷ যার ফলে দুই দেশই দ্বিদলীয় সমর্থন উপভোগ করে ৷

অ্যামেরিকা ভারতকে তাদের অন্যতম প্রতিরক্ষা সহযোগীর জায়গা দিয়েছে ৷ ওয়াশিংটনের নিকটতম প্রতিরক্ষা এবং কূটনৈতিক সহযোগীদের সঙ্গে সমানভাবে দিল্লিকেও নিয়ে এসেছে ৷

US ইন্ডিয়া পলিটিকাল অ্যাকশন কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রবিন্দর সচদেবের মতে বিডেন যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলেও দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তিগুলি একই পথে এগিয়ে যাবে ৷ কারণ, “বিস্তৃত ও গভীরতর ভারত-মার্কিন সম্পর্ক একটা নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছে গিয়েছে ৷ সেখান থেকে সম্পর্ক আশা করা হচ্ছে যে সামনের দিকেই এগোবে ৷”

সচদেব বলেন, “সামনের দিকে এগোনোর এই পথ কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে ৷ আপনি নিশ্চয় জানেন যে কিছু প্রশাসনের ক্ষেত্রে তার গতি বৃদ্ধি পায় ৷ আবার কিছু প্রশাসনে একই রকম গতিতে চলতে থাকে ৷ কিন্তু মারাত্মক গতি ও গভীরতার সঙ্গে এগোয় না ৷”

তবে একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন যে এটাও মনে রাখা দরকার যে একই সময়ে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চ ও নিম্ন, দুই কক্ষেই নির্বাচন রয়েছে ৷ যখন নিম্নকক্ষ হাউজ় অফ রিপ্রেজ়েন্টেটিভ ডেমোক্র্যাটরা নিয়ন্ত্রণ করেছে, তখন সেনেটে নিয়ন্ত্রণ ছিল রিপাবলিকানদের ৷

সচদেব বলেন, “যদি সেনেটে ডেমোক্র্যাটরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ফিরে আসে এবং বিডেন হোয়াইট হাউজ়ে থাকেন ৷ তখন আমি মনে করি মার্কন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক সরল পথ এগিয়ে যাবে ৷ কারণ, এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা ভারতের সমালোচনা করে ৷ আর হাউজ় ও সেনেট নিয়ন্ত্রণ করলে, সেটা করতে তাদের সুবিধাই হবে ৷”

“মনে রাখতে হবে যে মার্কিন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টই সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হন ৷ কিন্তু হাউজ় ও সেনেটের একসঙ্গে কিছু ক্ষমতা থাকে ৷ তারা অনেক কিছু করতে পারে ৷ তারা অনেক শর্ত আরোপ করতে পারে ৷ তারা বিল আনতে পারে ৷ কোনও বিল নিয়ে সংশোধনী বা রেজ়োলিশনও আনতে পারে ৷”

অ্যামেরিকা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চায় ৷ যা স্বচ্ছ এবং বিপরীতমুখী ৷ 2019 সালে পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য 149 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল ৷ অ্যামেরিকার তরফে করা শক্তি সংক্রান্ত রপ্তানি এই বাণিজ্য সম্পর্কের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়েছিল ৷

যদি বিডেন হোয়াইট হাউজ়ে প্রবেশ করেন, তাহলে অ্যামেরিকার সঙ্গে চিনের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে জল্পনা চলছে ৷

Covid-19 প্যানডেমিক যা চিনের উহান শহর থেকে ছড়িয়েছে, তা চিনের সঙ্গে অ্যামেরিকার সম্পর্কের বর্তমান অবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ৷ পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর মতে, এই অবস্থান থেকে বিডেন সরে আসতে পারবেন না ৷

এছাড়া অ্যামেরিকা ও চিনের মধ্যে অর্থনৈতিক বিবাদ চলছে ৷ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চিনের বিরুদ্ধে কিছু ট্যারিফ ও বাণিজ্য প্রতিরোধ তৈরি করার পর এই বিরোধ শুরু হয় ৷ এটাকে পরিবর্তন করাই আসল লক্ষ্য ৷ কারণ, ওয়াশিংটন এটাকে ‘অনুচিত বাণিজ্য অভ্যাস’ বলছে ৷ এই ধরনের বাণিজ্য অভ্যাস ও তার প্রভাবের মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি চুরি এবং মার্কিন প্রযুক্তিকে চিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ৷

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “এখন চিন কৌশলগত চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠেছে এবং বিডেন এটাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না ৷”

প্রাক্তন এই কূটনীতিক উল্লেখ করেছেন যে প্যানডেমিকের আড়ালে চিন কিছু পদক্ষেপ করেছে ৷ “কিন্তু বিস্তারিত ভাবে মার্কিন নীতি এখনও গ্রহণ করা হয়নি ৷”

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, যা জাপানের পূর্ব উপকূল থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত, সেখানে বেজিংয়ের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা অ্যামেরিকা ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আরও একটা কারণ ৷

বেজিংয়ের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ তুলে ওই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা তৈরি করার জন্য ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চতুর্দেশীয় জোট তৈরি করে কাজ করছে ৷

এছাড়া দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে চিনের অনড় মনোভাব এবং কিছু দেশের সঙ্গে এলাকা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে ৷

2017 সালে যে অ্যামেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে চিনকে ‘সংশোধনবাদী শক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ৷ সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে চক্রবর্তী জানিয়েছেন যে দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতি বদল করে দিয়েছেন ট্রাম্প ৷ আর এখন ইউনাইটেড নেশন কনভেনশন অন দা ল অফ দা সি (UNCLOS)-কে সমর্থনও করছে ৷

তিনি বলেন, “এই চতুর্দেশীয় জোট (ভারত, অ্যামেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া) আরও এগিয়ে যাবে ৷ আর চিন প্রতিবাদ করবে ৷”

সচদেবের মতে চিন নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান এবং বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও তীব্র ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে ৷

তিনি বলেন, “নভেম্বরের মধ্যে এর জন্য বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে বদলে যাবে ৷”

“কারণ, আপনি দেখবেন যে যখন আপনি কোনও রাস্তা ধরে এগিয়ে যান, তখন ফিরে আসা কার্যত অসম্ভব হয়ে যায় ৷ যেই শাসক হোন, যেই প্রেসিডেন্ট পদে বসুন, তিনি ট্রাম্প হোন কিংবা বিডেন, আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে তিনি চিন-বিরোধী নীতি এগিয়ে নিয়ে যাবেন ৷”

সচদেব জানিয়েছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে 2050 বা 2060 সালের মধ্যে চিন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি অথবা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সর্ব-শক্তিমান হয়ে উঠতে পারে ৷ অতীতের সর্ব-শক্তিমান হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রক্রিয়াকে আরও পিছিয়ে দিতে চাইছে ৷

তিনি বলেন, “এখন, ট্রাম্প প্রশাসনের সময় আমেরিকা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে চিনের এই উত্থানকে পিছিয়ে দিলে হবে না ৷ বরং আমাদের এই উত্থানকে থামিয়ে দিতে হবে ৷ যাতে চিন আর কখনওই এক নম্বর হয়ে উঠতে না পারে ৷”

“সুতরাং, এটা অনেক বড় লড়াই, যা চিনের বিরুদ্ধে শুরু করেছেন ট্রাম্প ৷ এখন, যদি বিডেনের প্রশাসন ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা কম বেশি একই পথে চলবে বলেই আশা করা যায় ৷ কারণ, একবার যখন অ্যামেরিকা এই বিষয়টিতে নিশ্চিত হয়েছে যে আমাদের চিনকে এক নম্বর হওয়া থেকে পিছিয়ে দিলে হবে না ৷ বরং থামিয়ে দিতে হবে ৷ তখন এই পথেই সবটা এগোবে ৷”

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.