কলকাতা, 18 ডিসেম্বর: দেখতে দেখতে এগারো বছরে পা দিল 'স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যাল'। দেশের অন্যতম সেরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উৎসব বলে সারা দেশেই সমাদৃত এই সুরের উৎসব । দেশের তাবড় তাবড় সঙ্গীত ওস্তাদরা এই উৎসবে শামিল হন । এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতি বছরের মতো এ বছরও তিন দিন ধরে নজরুল মঞ্চে চলেছিল এই সঙ্গীতের আসর। দীর্ঘ এগারো বছর ধরে দেশের অন্যতম সরোদ বাদক পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার এবং তাঁর পরিবার অর্থাৎ মানসী মজুমদার ও পুত্র ইন্দ্রায়ুধ মজুমদার 'স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যাল'-এর আয়োজন করে আসছেন । সমগ্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে শ্রী রঞ্জনী ফাউন্ডেশন ।
পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ তাঁর গুরু স্বর সম্রাট ওস্তাদ আলি আকবর খানের নামেই এই উৎসব করে আসছেন । বলা যেতে পারে এই উৎসব এক শিষ্যের গুরুদক্ষিণা । উৎসব প্রসঙ্গে তেজেন্দ্র নারায়ণ বলেন, "এই ফেস্টিভ্যালের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ আমার পরিবার এবং দর্শকের ভালোবাসা । এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে আমি আমার গুরুর প্রতি শ্ৰদ্ধা জানাই । আমি চাই আমার গুরুর প্রতি আপনাদের শ্রদ্ধা যেন আরও বাড়ে । আরও বড় মঞ্চে, আরও বড় আকারে এই ফেস্টিভ্যালকে নিয়ে যেতে চাই আমরা । তাই আপনাদের কাছে আশীর্বাদ কাম্য ।"
এ বছর স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যালে সঙ্গীত পরিবেশন করেন অন্যতম জনপ্রিয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী রাহুল দেশপান্ডে । তিনি মাওড়া বন্দিস দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন। শেষ করেন ভজন দিয়ে । প্রায় দেড় ঘণ্টা কলকাতা বুঁদ হয়ে রইল রাহুলের গায়কীতে। পরের বছর আবার শিল্পীকে নিয়ে আসবেন এমনই প্রতিশ্রুতি দেন তেজেন্দ্র নারায়ণ । প্রথম দিনে তবলা বাদক পণ্ডিত সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের একক তবলার অনুষ্ঠানও ছিল অনবদ্য । তাঁর গুরু পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের তৈরি করা বহু সুর তবলার বোলে শোনান তিনি ।
তিনি জানান পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের তৈরি করা রাগ-রাগিনীকেই পণ্ডিত রবি শঙ্কর 'কলকাতা ঘরানা' নামে অভিহিত করে গিয়েছেন । প্রথম দিনে বিদুষী এন রাজম এবং বিদুষী সঙ্গীতা শঙ্করের ভায়োলিন যুগলবন্দিও ছিল মনে রাখার মতো । তবলায় সঙ্গত করেন মায়েস্ত্র কুমার বোস । দ্বিতীয় দিনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ওস্তাদ শাহিদ পারভেজের সেতার বাদন । কলকাতার শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর বাজনা শুনেছে । এই বছর জীবনকৃতি পুরস্কার দেওয়া হয় বর্ষীয়ান সঙ্গীতশিল্পী সঙ্গীতাচার্য অমিয় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে । ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আঙিনায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য । জীবনকৃতি পুরস্কার গ্রহণ করার পর তাঁর অনুষ্ঠান ছিল দ্বিতীয় দিনের সেরা প্রাপ্তি । তিনি বলেন, "আমার জন্য যে এত কিছু আয়োজন করা হয়েছে, তাতেই আমি কৃতজ্ঞ।" এই বয়সেও তাঁর গায়কীতে মজে রইলেন শ্রোতারা ৷
সরোদ বাদক পন্ডিত দেবজ্যোতি বোস এবং তবলায় মায়েস্ত্র পণ্ডিত স্বপন চৌধুরীর যুগলবন্দিও দ্বিতীয় দিনে দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে । সেই দিন পণ্ডিত কুমার বসের আত্মজীবনী 'তবলাওয়ালা'-র প্রচ্ছদ উন্মোচিত হয় । শেষদিনের মূল আকর্ষণ বলাই বাহুল্য স্বয়ং জাকির হোসেন ৷ নজরুল মঞ্চ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ । স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যালে এই নিয়ে দশ বছর ধরে বাজিয়ে চলেছেন জাকির হোসেন । এবারেও তিনি বাজালেন এবং জয় করে নিলেন কলকাতার হৃদয় । তিনি বলেন, "শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এমন সমঝদার দর্শক কলকাতার মতো আর কোথাও নেই।" তিনি রাগ যোগ দিয়ে শুরু করেন। আর শেষ করেন মহাদেবের ডমরু এবং শঙ্খের ধ্বণি শুনিয়ে । গোটা নজরুল মঞ্চ তখন কানায় কানায় ভরা । শীতের আমেজ কাটিয়ে তখন কেবল জাকির-উষ্ণতা।
আরও পড়ুন: