ETV Bharat / entertainment

Rajatava Dutta: 'ঘুরে দাঁড়াতে বাংলা ছবির একটা শোলে দরকার', দাবি রজতাভর - Rajatava Dutta Upcoming Films

Rajatava Dutta Speaks to ETV Bharat: রজতাভ দত্ত বাংলা সিনেমায় অতি পরিচিত এক মুখ ৷ নতুন ছবি থেকে অভিনয় জীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি অভিরূপ দাসের সঙ্গে আড্ডা দিলেন দর্শকদের প্রিয় রণি দা ৷

Rajatava Dutta
অভিনয় জীবন নিয়ে অকপট রজতাভ
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Sep 18, 2023, 10:46 AM IST

Updated : Sep 18, 2023, 11:01 AM IST

কলকাতা, 14 সেপ্টেম্বর: তিনি রজতাভ দত্ত । পরিচয় দিতে নামটাই যথেষ্ট। দু’ধরনের সিনেমাতেই সমানভাবে অভিনয় করে চলেছেন শেষ কয়েক দশক ধরে। কখনও তিনি তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির খলনায়ক। কখনও আবার পুলিশের বড় কর্তা। অবার কখনও পর্দায় এসেছেন লেখক হয়ে। সন্দীপ রায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সম্প্রতি হিন্দি সিরিজে রাজ এবং ডিকের মতো একাধিক নামজাদা পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। সম্প্রতি কাজ করেছেন কমলেশ্বরের পরপর দু'টি ছবিতে। একটি 'একটু সরে বসুন' আর অন্যটি 'আমি আমার মতো' । কাজের অভিজ্ঞতা থেকে ছবিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের ব্যবহার নিয়ে কী ভাবছেন তিনি ?

প্রশ্ন: আপনাকে নানা ধরনের চরিত্রে দেখতে পাই আমরা। কখনও খলনায়ক তো কখনও ধরা দেন কমেডি চরিত্রে। কোন ধরনের চরিত্রে নিজেকে খুঁজে পান?

উত্তর: এটা বোঝা খুব মুশকিল। মানুষ তো এক ধরনের হয় না। এই লোকটা রাগী । ওই লোকটা গম্ভীর বা হাসকুটে এমন একটা লেবেল সেঁটে দিলে হয়তো সমাজিকভাবে অন্যদের সুবিধা হয়। আর বাণিজ্যিক ছবিও এই ধরনের ব্র্যান্ডিং চায়। কিন্তু একটা মানুষের মধ্যে আসলে অনেক ধরনের মানুষ থাকে। তাই আমার কোন চরিত্র করতে ভালো লাগে জানতে চাইলে বলব, ভালো চিত্রনাট্য আর ভালো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে সবসময় ভালো লাগে। ভালো পরিচালক চিত্রনাট্যের বাইরে গিয়েও চরিত্রদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারেন।

প্রশ্ন: কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরপর দু'টি ছবিতে কাজ করছেন। চরিত্র দু'টি কেমন ?

উত্তর: দু'টি চরিত্রের মধ্যে একেবারে আকাশ পাতাল ফারাক। 'একটু সরে বসুন' ছবিতে আমার চরিত্রটি খুব সফল কর্পোরেট বসের। সে প্রতিষ্ঠিত। সে নিজের নিন্ম মধ্যবিত্ত অতীতটাকে ভুলে যেতে চায়। আজকের জীবনযাত্রায় সবসময় নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চায়। আপাতদৃষ্টিতে তাকে অমানবিক এবং বদমেজাজিও মনে হয়। খুব ক্যারিশ্মাটিক চরিত্র। সে এও বারবার বলে তার জীবনে নাকি প্রচুর প্রেম ছিল। তবে ছবিতে সে একজন অনুগত স্বামী। মানে ধরে নিতে পারা যায় ওটা মধ্যবয়স্ক একজন সফল মানুষের চরিত্র ।

অন্যদিকে, 'আমি আমার মতো' ছবিতে আমার চরিত্রটা একজন অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট অফিসের কেরানির। সে জীবনে সবদিক থেকে হেরে গিয়েছে। তার ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। সে মদ্যপ। কোনও কোনও দিন বাড়িতে রাতে খাবারও থাকে না। একটা বিষাদ মিশে রয়েছে এই চরিত্রটায়। তবে উপর থেকে তাকে আবার ঠকবাজ বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে সে একা। তার জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখটাই বেশি। ছেলে আমেরিকায় থাকে। সবমিলিয়ে হেরে যাওয়া একটি চরিত্র । দু'টো চরিত্রের বয়সের পার্থক্যও প্রায় 15-20 বছর ।

প্রশ্ন: দু'টি চরিত্রের প্রস্তুতিটা নিয়েও একটু যদি বলেন। আপনি কি মেথড অ্যাকটিংয়ে বিশ্বাস করেন?

উত্তর: আমারা অনেক মেথডের কথা তত্ত্বে পড়েছি একসময়। কিন্তু এটা এককথায় বলা খুব মুশকিল যে আমি মেথড অ্যাকটিংয়ে বিশ্বাস করি কি না? আসলে আমাদের এখানে এত দ্রুত কাজ করতে হয় যে একটা চরিত্রের পর দু’বছরের ব্রেক নেওয়া মুশকিল। একটা চরিত্র থেকে নিজেকে একেবারে আলাদা করে অন্য একটা চরিত্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব না ৷ এক বা দু'বছর ধরে শুটিং হবে। তারও আগে 5-6 মাস ধরে সেই চরিত্রের পোশাক পরে হাঁটব। তার মতো করে কথা বলা অনুশীলন করব-এমন কোনও সুযোগ আমাদের নেই ।

গড়পড়তা বাংলা ছবির শুটিং শেষ হয় 20-22 দিন। কখনও কখনও 11-12 দিনেও কাজ শেষ হযে যায়। সেটা আমি নাম ভূমিকায় থাকলেও। ‘আমি আমার মতো’ ছবিতে আমার কাজ ছিল 16 দিনের। আগে বাংলা ছবি তৈরি হত 45 দিনে । আর দক্ষিণে বা হিন্দিতে কিংবা হলিউডের বিগ বাজেটের ছবি দুই থেকে আড়াই বছর ধরে তৈরি করা হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিচালক চার থেকে দশ বছর ধরেও ছবির প্রস্তুতি নেন। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যাপারটা আলাদা। রাত এগারোটায় একটা শুটিং সেরে ফিরলাম। আবার সকাল সাতটায় অন্য চরিত্র হয়ে বিছানা ছাড়তে হয়। তাই মেথড অ্যাকটিংয়ের সুযোগ আমরা পাই না ।

আরও পড়ুন: 'চরিত্রই ঠিক করে দেয় প্রস্তুতি কেমন হবে', অভিনয় জীবন নিয়ে অকপট ঋত্বিক

প্রশ্ন: এটা কি টাইপ চরিত্র হয়ে যাওয়ার ভয় তৈরি করে না?

উত্তর: তুমি চাইলে টাইপ চরিত্র হয়ে যেতেই পারো। আর যদি না চাও তাহলে প্রতিটা কাজেই নিজের খোল নলচে বদলে নিতে পারো। আমি কমলেশ্বরের দু'টো কাজ করলাম। আমি তোমায় আগেই বললাম এই দু'টো চরিত্রের বয়সের পার্থক্য প্রায় 15-20 বছর। তাই বাকি সব বাদ দিলেও আমি প্রথমেই একটা টুল পেয়ে গেলাম । বুঝলাম, কীভাবে দু'টো চরিত্রের মধ্যে তফাত করতে পারি। তারপর অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের মতো নানা বিষয় রয়েছে। এই টুলগুলো খুব সহজ। কিন্তু আমার কাছে অতীতে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি ছিল। আমি আমার জীবনে 60 শতাংশেরও বেশি বাণিজ্যিক ছবি করেছি। তার মধ্যে আবার 60 শতাংশের উপর নেগেটিভ চরিত্র ।

মজা করেই বলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছি 17 বার। সেখানে এক পরিচালক, এক নায়ক আবার একই চিত্রনাট্যকার। আর আমি প্রতিটা ছবিতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এটা আমার কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রতিটা ছবিতে নিজেকে আলাদা করব কীভাবে সেটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। একজন ভালো পরিচালক বা ভালো স্ক্রিপ্ট পেলে সমস্যা থাকে না। কারণ তিনিই তোমাকে পথ দেখাতে পারবেন। বলে দিতে পারবেন, কোন উপাচারে তুমি তোমার চরিত্রটাকে সাজাবে।

কিন্তু তখন পরিস্থিতি আলাদা। বাইরের কোনও সাহায্য পাচ্ছি না। আমি যা করছি তাতেই তাঁরা অভিভূত। কিংবা হয়তো আমাকে তাঁরা ছবি করার আগেই দক্ষিণি কপিটা দেখিয়ে দেওয়ার প্রাণপন চেষ্টা করছেন। তখন অসুবিধা হয়। আমি জীবনে দক্ষিণি ছবি দেখে কোনও কাজ করিনি। আমি বলতাম আমি খুব খারাপ ভ্যাঙাই। তাই ওটা করতে হলে অন্য কাউকে নিন। যেহেতু আমার কয়েকটা ওই ধরনের ছবি সফল হয়েছিল তাই আমাকে তাঁরা রেয়াত করেছেন। না-হলে বাদ দিয়ে দিতেন। কিন্তু এই ধরনের চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে আমায় ব্যক্তিগত স্কিল দিয়ে নজর টানতে হয়েছে বৈকি।

প্রশ্ন: একটা সময় বাঁধা চাকরি ছেড়ে অভিনয়ে এসেছিলেন। জীবনের স্ট্রাগলিং সময়টাকে আজ কীভাবে দেখেন?

উত্তর: তখন সেটাকে স্ট্রাগল বলে বুঝতে পারিনি। আজ এত বছর পর সেটাকে স্ট্রাগল বলে মনে হয়। তখন মনে হত প্রতিটা মানুষ এভাবেই এগিয়ে যায়। আমার প্রাপ্তির ঝুলিতে যে এতকিছু আসবে তা সেদিন জানা ছিল না। আমি জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছি। থিয়েটারের দলে বসে থাকা সাধারণ ছেলে হিসাবে কাজ শুরু করেছি। তাই আমার কাছে প্রতিটা দিন ছিল পরের দিনের সিঁড়ির ধাপ। কোনও পাহাড়ে চড়ার মতো ছিল না বিষয়টা। সিঁড়িগুলো এতই ছোট ছোট যে সেগুলো পেরচ্ছি তা টেরই পাইনি। কারণ নিজেকে আমি কখনও অভিনেতা বলে মনে করিনি। আমার ভীষণ হীনমন্যতাও ছিল অনেকগুলো বিষয়ে। আমার চেহারা নিয়ে এমনকী দক্ষতা নিয়েও। একমাত্র আত্মবিশ্বাসের জায়গা ছিল গান নিয়ে।

জীবনের একেকটা ধাপে আলাদা আলাদা শিক্ষক পেয়েছি। তাই স্ট্রাগল করছি এমন কোনওদিন মনে হয়নি। একেকটা থিয়েটার আমায় একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। তাই 150 টাকার কাজ যখন মাসে তিনটে করেছি তখনও মনে হত ব্যাস আর কী চাই! চাকরিটা ছাড়লাম তখনও মনে হল যাক চাকরি ছাড়ার সাহস তো দেখাতে পারলাম। নিজের জীবন আর পৃথিবী নিয়ে বিস্মিত হয়ে থাকার বিষয়টা আমার কাছে বারবার জিতে গিয়েছে । অতৃপ্তি থাকবেই। 100 নম্বরের হিসেবে সেটা 5 আর 95 তৃপ্তি। যার জেরে প্রতিদিন রাতে শুতে যাওয়ার সময় মনে হত একটা দারুণ দিন কাটালাম। আর সকালে উঠে মনে হত একটা দারুণ দিন কাটাব।

একটা মজার তথ্য জানাই। আমি একটু বেলা করে উঠতাম যাতে ব্রেকফাস্ট না করতে হয়। কিংবা রাস্তার ধারে বিকেলে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পাশেই রোলের দোকান। ভাবছি একটা চেনা বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেই গল্প জুড়ে দেব। সে কি আর একটা রোল আমায় খাওয়াবে না! কিন্তু সেদিনও নিজেকে ঘৃণা করিনি বরং সবটাই মজা লাগত।

আরও পড়ুন: ঋত্বিকের সঙ্গে কাজ, না-ঘুমিয়ে স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করেছিলেন ‘গোরার সারথী’ সুহোত্র

প্রশ্ন: থিয়েটার আপনার জীবন বদলে দিয়েছে। একথা আপনি বারবার বলেন। কী বলবেন?

উত্তর: থিয়েটারের আগের যে জীবন আমার ছিল সেটাকেই বিক্রি করে সংসার চলে আমার । আমার ধারণা আরও কয়েকটা জন্মও চলে যাবে। তখন আমি যেখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই দুনিয়ার সঙ্গে গত 20-25 বছর যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তবে আসল উপাদানটা তো বদলায় না। প্রকাশভঙ্গি হয়তো বদলেছে ৷ সেটাকে আমি আজ আমার দক্ষতা দিয়ে নতুন ভাষা দিতে পারি।

প্রশ্ন: দু'ধরনের ছবিতেই আপনি সমান দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন। বাংলা কমার্শিয়াল ছবির ধারাটা এখন অনেকটা বদলে গিয়েছে । কিন্তু আগে আপনি দেব বা জিতের সঙ্গে যে কাজ করেছেন সেরকম কাজ আজ হচ্ছে না বলেই কি বলতে হচ্ছে 'বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান।'

উত্তর: কমার্শিয়াল ছবিকে কখনওই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কমার্শিয়াল ছবি চললে টাকা আসবে। সেটা দিয়ে অন্যধারার ছবি তৈরি হবে। আমি দীর্ঘ সময় কমার্শিয়াল ছবি করেছি। তাতে আমার কোনও লজ্জা নেই। বরং আমি গর্বিত। কারণ, তার জন্যই আমার একটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। শুধু এগুলো দক্ষিণি ছবির কপি না হলে খুশি হতাম ৷

কিন্তু 'লার্জার দ্যান লাইফ' সিনেমার কাছে বাংলা ছবিকে ফিরতেই হবে। বাংলা ছবির ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য একটা শোলে দরকার এখন। আমি নিশ্চিত নই তবে বিভিন্ন লেখায় পড়েছি সত্যজিৎ রায় নাকি রমেশ সিপ্পিকে বলেছিলেন, আমি এটা (শোলে) বানাতে পারতাম না । সত্যজিৎ পারতেন না নাকি চাইতেন না সেই তর্কে না গিয়েই বলছি ব্যাপারটা কিন্তু সম্মানের। এই মুহূর্তে একটা গণ্ডিতে আটকে গিয়েছে বাংলা ছবি।

বলা হচ্ছে, বাজার ছোট বলে বাজেট কমছে। কিন্তু আসলে ছবির বাজেট ছোট বলে বাজার আরও ছোট হচ্ছে। মাল্টিপ্লেক্সে আমার 80 লক্ষ টাকা দিয়ে তৈরির ছবির পাশে 280 কোটি বাজেটের সিনেমা চলছে। এটা গুলতি নিয়ে ফাইটার প্লেন আর কামানের সঙ্গে লড়াই করার মতো। এটাকে অসম লড়াইও বলা যায় না!

আরও পড়ুন: নতুূন জুটির পাশে খরাজ-রজতাভ-শান্তিলাল, আসছে নতুন ছবি 'কোথায় তুমি'

প্রশ্ন: এআই নিয়ে বর্তমানে চর্চা চলেছে। হলিউডে আন্দোলনও শুরু হয়ে গিয়েছে। সেটাকে কীভাবে দেখছেন?

উত্তর: ওই যে বললাম আমরা গুলতি নিয়ে লড়াই করি। তার একটা মানে আমরা সস্তা। তাই হয়তো আমরা বেঁচে যাব। কাম্য বা কাম্য নয় বলে পৃথিবীর অগ্রগতিকে রোখা যায় না। কোথায় যেন পড়ছিলাম আজ থেকে বেশ কিছু বছর বাদে অনেক চাকরি হারিয়ে যাবে। গাড়ি চালানোর ব্যাপারটা এই তালিকাতেই পড়ে। অনেকে কাজ হারাবেন। বিদেশের বন্ধুদের কাছে এমন গাড়ি দেখেছি আমি। তবে আমরা তো সস্তা। আমরা হয়তো বেঁচে যাব!

কলকাতা, 14 সেপ্টেম্বর: তিনি রজতাভ দত্ত । পরিচয় দিতে নামটাই যথেষ্ট। দু’ধরনের সিনেমাতেই সমানভাবে অভিনয় করে চলেছেন শেষ কয়েক দশক ধরে। কখনও তিনি তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির খলনায়ক। কখনও আবার পুলিশের বড় কর্তা। অবার কখনও পর্দায় এসেছেন লেখক হয়ে। সন্দীপ রায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সম্প্রতি হিন্দি সিরিজে রাজ এবং ডিকের মতো একাধিক নামজাদা পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। সম্প্রতি কাজ করেছেন কমলেশ্বরের পরপর দু'টি ছবিতে। একটি 'একটু সরে বসুন' আর অন্যটি 'আমি আমার মতো' । কাজের অভিজ্ঞতা থেকে ছবিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের ব্যবহার নিয়ে কী ভাবছেন তিনি ?

প্রশ্ন: আপনাকে নানা ধরনের চরিত্রে দেখতে পাই আমরা। কখনও খলনায়ক তো কখনও ধরা দেন কমেডি চরিত্রে। কোন ধরনের চরিত্রে নিজেকে খুঁজে পান?

উত্তর: এটা বোঝা খুব মুশকিল। মানুষ তো এক ধরনের হয় না। এই লোকটা রাগী । ওই লোকটা গম্ভীর বা হাসকুটে এমন একটা লেবেল সেঁটে দিলে হয়তো সমাজিকভাবে অন্যদের সুবিধা হয়। আর বাণিজ্যিক ছবিও এই ধরনের ব্র্যান্ডিং চায়। কিন্তু একটা মানুষের মধ্যে আসলে অনেক ধরনের মানুষ থাকে। তাই আমার কোন চরিত্র করতে ভালো লাগে জানতে চাইলে বলব, ভালো চিত্রনাট্য আর ভালো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে সবসময় ভালো লাগে। ভালো পরিচালক চিত্রনাট্যের বাইরে গিয়েও চরিত্রদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারেন।

প্রশ্ন: কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরপর দু'টি ছবিতে কাজ করছেন। চরিত্র দু'টি কেমন ?

উত্তর: দু'টি চরিত্রের মধ্যে একেবারে আকাশ পাতাল ফারাক। 'একটু সরে বসুন' ছবিতে আমার চরিত্রটি খুব সফল কর্পোরেট বসের। সে প্রতিষ্ঠিত। সে নিজের নিন্ম মধ্যবিত্ত অতীতটাকে ভুলে যেতে চায়। আজকের জীবনযাত্রায় সবসময় নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চায়। আপাতদৃষ্টিতে তাকে অমানবিক এবং বদমেজাজিও মনে হয়। খুব ক্যারিশ্মাটিক চরিত্র। সে এও বারবার বলে তার জীবনে নাকি প্রচুর প্রেম ছিল। তবে ছবিতে সে একজন অনুগত স্বামী। মানে ধরে নিতে পারা যায় ওটা মধ্যবয়স্ক একজন সফল মানুষের চরিত্র ।

অন্যদিকে, 'আমি আমার মতো' ছবিতে আমার চরিত্রটা একজন অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট অফিসের কেরানির। সে জীবনে সবদিক থেকে হেরে গিয়েছে। তার ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। সে মদ্যপ। কোনও কোনও দিন বাড়িতে রাতে খাবারও থাকে না। একটা বিষাদ মিশে রয়েছে এই চরিত্রটায়। তবে উপর থেকে তাকে আবার ঠকবাজ বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে সে একা। তার জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখটাই বেশি। ছেলে আমেরিকায় থাকে। সবমিলিয়ে হেরে যাওয়া একটি চরিত্র । দু'টো চরিত্রের বয়সের পার্থক্যও প্রায় 15-20 বছর ।

প্রশ্ন: দু'টি চরিত্রের প্রস্তুতিটা নিয়েও একটু যদি বলেন। আপনি কি মেথড অ্যাকটিংয়ে বিশ্বাস করেন?

উত্তর: আমারা অনেক মেথডের কথা তত্ত্বে পড়েছি একসময়। কিন্তু এটা এককথায় বলা খুব মুশকিল যে আমি মেথড অ্যাকটিংয়ে বিশ্বাস করি কি না? আসলে আমাদের এখানে এত দ্রুত কাজ করতে হয় যে একটা চরিত্রের পর দু’বছরের ব্রেক নেওয়া মুশকিল। একটা চরিত্র থেকে নিজেকে একেবারে আলাদা করে অন্য একটা চরিত্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব না ৷ এক বা দু'বছর ধরে শুটিং হবে। তারও আগে 5-6 মাস ধরে সেই চরিত্রের পোশাক পরে হাঁটব। তার মতো করে কথা বলা অনুশীলন করব-এমন কোনও সুযোগ আমাদের নেই ।

গড়পড়তা বাংলা ছবির শুটিং শেষ হয় 20-22 দিন। কখনও কখনও 11-12 দিনেও কাজ শেষ হযে যায়। সেটা আমি নাম ভূমিকায় থাকলেও। ‘আমি আমার মতো’ ছবিতে আমার কাজ ছিল 16 দিনের। আগে বাংলা ছবি তৈরি হত 45 দিনে । আর দক্ষিণে বা হিন্দিতে কিংবা হলিউডের বিগ বাজেটের ছবি দুই থেকে আড়াই বছর ধরে তৈরি করা হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিচালক চার থেকে দশ বছর ধরেও ছবির প্রস্তুতি নেন। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যাপারটা আলাদা। রাত এগারোটায় একটা শুটিং সেরে ফিরলাম। আবার সকাল সাতটায় অন্য চরিত্র হয়ে বিছানা ছাড়তে হয়। তাই মেথড অ্যাকটিংয়ের সুযোগ আমরা পাই না ।

আরও পড়ুন: 'চরিত্রই ঠিক করে দেয় প্রস্তুতি কেমন হবে', অভিনয় জীবন নিয়ে অকপট ঋত্বিক

প্রশ্ন: এটা কি টাইপ চরিত্র হয়ে যাওয়ার ভয় তৈরি করে না?

উত্তর: তুমি চাইলে টাইপ চরিত্র হয়ে যেতেই পারো। আর যদি না চাও তাহলে প্রতিটা কাজেই নিজের খোল নলচে বদলে নিতে পারো। আমি কমলেশ্বরের দু'টো কাজ করলাম। আমি তোমায় আগেই বললাম এই দু'টো চরিত্রের বয়সের পার্থক্য প্রায় 15-20 বছর। তাই বাকি সব বাদ দিলেও আমি প্রথমেই একটা টুল পেয়ে গেলাম । বুঝলাম, কীভাবে দু'টো চরিত্রের মধ্যে তফাত করতে পারি। তারপর অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের মতো নানা বিষয় রয়েছে। এই টুলগুলো খুব সহজ। কিন্তু আমার কাছে অতীতে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি ছিল। আমি আমার জীবনে 60 শতাংশেরও বেশি বাণিজ্যিক ছবি করেছি। তার মধ্যে আবার 60 শতাংশের উপর নেগেটিভ চরিত্র ।

মজা করেই বলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছি 17 বার। সেখানে এক পরিচালক, এক নায়ক আবার একই চিত্রনাট্যকার। আর আমি প্রতিটা ছবিতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এটা আমার কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রতিটা ছবিতে নিজেকে আলাদা করব কীভাবে সেটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। একজন ভালো পরিচালক বা ভালো স্ক্রিপ্ট পেলে সমস্যা থাকে না। কারণ তিনিই তোমাকে পথ দেখাতে পারবেন। বলে দিতে পারবেন, কোন উপাচারে তুমি তোমার চরিত্রটাকে সাজাবে।

কিন্তু তখন পরিস্থিতি আলাদা। বাইরের কোনও সাহায্য পাচ্ছি না। আমি যা করছি তাতেই তাঁরা অভিভূত। কিংবা হয়তো আমাকে তাঁরা ছবি করার আগেই দক্ষিণি কপিটা দেখিয়ে দেওয়ার প্রাণপন চেষ্টা করছেন। তখন অসুবিধা হয়। আমি জীবনে দক্ষিণি ছবি দেখে কোনও কাজ করিনি। আমি বলতাম আমি খুব খারাপ ভ্যাঙাই। তাই ওটা করতে হলে অন্য কাউকে নিন। যেহেতু আমার কয়েকটা ওই ধরনের ছবি সফল হয়েছিল তাই আমাকে তাঁরা রেয়াত করেছেন। না-হলে বাদ দিয়ে দিতেন। কিন্তু এই ধরনের চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে আমায় ব্যক্তিগত স্কিল দিয়ে নজর টানতে হয়েছে বৈকি।

প্রশ্ন: একটা সময় বাঁধা চাকরি ছেড়ে অভিনয়ে এসেছিলেন। জীবনের স্ট্রাগলিং সময়টাকে আজ কীভাবে দেখেন?

উত্তর: তখন সেটাকে স্ট্রাগল বলে বুঝতে পারিনি। আজ এত বছর পর সেটাকে স্ট্রাগল বলে মনে হয়। তখন মনে হত প্রতিটা মানুষ এভাবেই এগিয়ে যায়। আমার প্রাপ্তির ঝুলিতে যে এতকিছু আসবে তা সেদিন জানা ছিল না। আমি জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছি। থিয়েটারের দলে বসে থাকা সাধারণ ছেলে হিসাবে কাজ শুরু করেছি। তাই আমার কাছে প্রতিটা দিন ছিল পরের দিনের সিঁড়ির ধাপ। কোনও পাহাড়ে চড়ার মতো ছিল না বিষয়টা। সিঁড়িগুলো এতই ছোট ছোট যে সেগুলো পেরচ্ছি তা টেরই পাইনি। কারণ নিজেকে আমি কখনও অভিনেতা বলে মনে করিনি। আমার ভীষণ হীনমন্যতাও ছিল অনেকগুলো বিষয়ে। আমার চেহারা নিয়ে এমনকী দক্ষতা নিয়েও। একমাত্র আত্মবিশ্বাসের জায়গা ছিল গান নিয়ে।

জীবনের একেকটা ধাপে আলাদা আলাদা শিক্ষক পেয়েছি। তাই স্ট্রাগল করছি এমন কোনওদিন মনে হয়নি। একেকটা থিয়েটার আমায় একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। তাই 150 টাকার কাজ যখন মাসে তিনটে করেছি তখনও মনে হত ব্যাস আর কী চাই! চাকরিটা ছাড়লাম তখনও মনে হল যাক চাকরি ছাড়ার সাহস তো দেখাতে পারলাম। নিজের জীবন আর পৃথিবী নিয়ে বিস্মিত হয়ে থাকার বিষয়টা আমার কাছে বারবার জিতে গিয়েছে । অতৃপ্তি থাকবেই। 100 নম্বরের হিসেবে সেটা 5 আর 95 তৃপ্তি। যার জেরে প্রতিদিন রাতে শুতে যাওয়ার সময় মনে হত একটা দারুণ দিন কাটালাম। আর সকালে উঠে মনে হত একটা দারুণ দিন কাটাব।

একটা মজার তথ্য জানাই। আমি একটু বেলা করে উঠতাম যাতে ব্রেকফাস্ট না করতে হয়। কিংবা রাস্তার ধারে বিকেলে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পাশেই রোলের দোকান। ভাবছি একটা চেনা বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেই গল্প জুড়ে দেব। সে কি আর একটা রোল আমায় খাওয়াবে না! কিন্তু সেদিনও নিজেকে ঘৃণা করিনি বরং সবটাই মজা লাগত।

আরও পড়ুন: ঋত্বিকের সঙ্গে কাজ, না-ঘুমিয়ে স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করেছিলেন ‘গোরার সারথী’ সুহোত্র

প্রশ্ন: থিয়েটার আপনার জীবন বদলে দিয়েছে। একথা আপনি বারবার বলেন। কী বলবেন?

উত্তর: থিয়েটারের আগের যে জীবন আমার ছিল সেটাকেই বিক্রি করে সংসার চলে আমার । আমার ধারণা আরও কয়েকটা জন্মও চলে যাবে। তখন আমি যেখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই দুনিয়ার সঙ্গে গত 20-25 বছর যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তবে আসল উপাদানটা তো বদলায় না। প্রকাশভঙ্গি হয়তো বদলেছে ৷ সেটাকে আমি আজ আমার দক্ষতা দিয়ে নতুন ভাষা দিতে পারি।

প্রশ্ন: দু'ধরনের ছবিতেই আপনি সমান দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন। বাংলা কমার্শিয়াল ছবির ধারাটা এখন অনেকটা বদলে গিয়েছে । কিন্তু আগে আপনি দেব বা জিতের সঙ্গে যে কাজ করেছেন সেরকম কাজ আজ হচ্ছে না বলেই কি বলতে হচ্ছে 'বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান।'

উত্তর: কমার্শিয়াল ছবিকে কখনওই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কমার্শিয়াল ছবি চললে টাকা আসবে। সেটা দিয়ে অন্যধারার ছবি তৈরি হবে। আমি দীর্ঘ সময় কমার্শিয়াল ছবি করেছি। তাতে আমার কোনও লজ্জা নেই। বরং আমি গর্বিত। কারণ, তার জন্যই আমার একটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। শুধু এগুলো দক্ষিণি ছবির কপি না হলে খুশি হতাম ৷

কিন্তু 'লার্জার দ্যান লাইফ' সিনেমার কাছে বাংলা ছবিকে ফিরতেই হবে। বাংলা ছবির ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য একটা শোলে দরকার এখন। আমি নিশ্চিত নই তবে বিভিন্ন লেখায় পড়েছি সত্যজিৎ রায় নাকি রমেশ সিপ্পিকে বলেছিলেন, আমি এটা (শোলে) বানাতে পারতাম না । সত্যজিৎ পারতেন না নাকি চাইতেন না সেই তর্কে না গিয়েই বলছি ব্যাপারটা কিন্তু সম্মানের। এই মুহূর্তে একটা গণ্ডিতে আটকে গিয়েছে বাংলা ছবি।

বলা হচ্ছে, বাজার ছোট বলে বাজেট কমছে। কিন্তু আসলে ছবির বাজেট ছোট বলে বাজার আরও ছোট হচ্ছে। মাল্টিপ্লেক্সে আমার 80 লক্ষ টাকা দিয়ে তৈরির ছবির পাশে 280 কোটি বাজেটের সিনেমা চলছে। এটা গুলতি নিয়ে ফাইটার প্লেন আর কামানের সঙ্গে লড়াই করার মতো। এটাকে অসম লড়াইও বলা যায় না!

আরও পড়ুন: নতুূন জুটির পাশে খরাজ-রজতাভ-শান্তিলাল, আসছে নতুন ছবি 'কোথায় তুমি'

প্রশ্ন: এআই নিয়ে বর্তমানে চর্চা চলেছে। হলিউডে আন্দোলনও শুরু হয়ে গিয়েছে। সেটাকে কীভাবে দেখছেন?

উত্তর: ওই যে বললাম আমরা গুলতি নিয়ে লড়াই করি। তার একটা মানে আমরা সস্তা। তাই হয়তো আমরা বেঁচে যাব। কাম্য বা কাম্য নয় বলে পৃথিবীর অগ্রগতিকে রোখা যায় না। কোথায় যেন পড়ছিলাম আজ থেকে বেশ কিছু বছর বাদে অনেক চাকরি হারিয়ে যাবে। গাড়ি চালানোর ব্যাপারটা এই তালিকাতেই পড়ে। অনেকে কাজ হারাবেন। বিদেশের বন্ধুদের কাছে এমন গাড়ি দেখেছি আমি। তবে আমরা তো সস্তা। আমরা হয়তো বেঁচে যাব!

Last Updated : Sep 18, 2023, 11:01 AM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.