কলকাতা, 30 মে: ভারতীয় সিনেমার জন্য 30 মে দিনটা সত্যিই যেন 'বিষাদ দিবস' ৷ কারণ এই দিনেই তাঁর ছায়াছবির 'গহন কুসুম কুঞ্জ' ছেড়ে বিদায় নিয়েছিলেন সকলের প্রিয় ঋতুপর্ণ ঘোষ ৷ মাত্র 49 বছর বয়সে তাঁর এই প্রয়াণ আজ দশটা বছর পরেও মেনে নিতে সমস্যা হয় অনেকের ৷ বিজ্ঞাপনের জগত থেকে কাজ শুরু করা ঋতুপর্ণ ছিলেন সেলুলয়েডের সেরা গল্প বলিয়েদের অন্যতম ৷ তা সে যে বয়সের জন্য়ই তিনি ছবি বানান না কেন? গল্প বলার দক্ষতা যে তাঁর সহজাত তা বারবার বুঝিয়েছেন তিনি ।
প্রথম ছবি 'হীরের আংটি' তিনি বানিয়েছিলেন ছোটদের জন্য়ই ৷ তবে ছোটদের জন্য হলেও তা সর্বজনীন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পকে হাতিয়ার করে সেই প্রথম রূপোলি পর্দায় পা রেখেছিলেন 29 বছর বয়সি এক তরুণ ৷ কিংবদন্তি সত্য়জিৎ রায়কে তাঁর এই ছবিটা দেখানোর সাধ ছিল ঋতুর কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি ৷ আপশোস ছিল সারা জীবন ৷ সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল পরবর্তী যুগের ছবি নির্মাতাদের জন্য ঋতুপর্ণ যে মাইলস্টোন হয়ে উঠেছেন তা বলাই বাহুল্য় ৷
বাংলা সিনেমাকে বিশ্বজনীন প্রেক্ষাপটে পৌঁছে দেওয়া এই পরিচালক সারাজীবন পর্দার রূপোলি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর নিজের জীবন দর্শনকে ৷ 'ঊনিশে এপ্রিল', 'দহন', 'বাড়িওয়ালি', 'খেলা', 'আবহমান', 'দোসর', 'সব চরিত্র কাল্পনিক', 'রেনকোট', 'দ্য লাস্ট লিয়র'-এর কথা অনেকেই বলবেন তাঁর ছবির কথা সামনে এলেই ৷ প্রতিটা ছবিতেই তিনি প্রাধান্য় দিয়েছেন জীবনের গল্পকে ৷ কোথাও এক চিত্র পরিচালক এবং তাঁর পরিবারের কাহিনি উঠে এসেছে তাঁর চিত্রপটে, কোথাও আবার এক বাড়িওয়ালির নিসঙ্গ হাহাকার এসে ছুঁয়ে দিয়ে গিয়েছে হৃদয় ৷
বাংলা সিনেমাকে কী দিয়ে গেলেন ঋতুপর্ণ? শুধু কি গল্প বলার কৌশল, শুধু কি কিছু অসাধারণ ফ্রেম অথবা রূপোলি পর্দার কিছু অসামান্য মুহূর্ত? উত্তর 'না'। কালো ফ্রেমের চশমা, মাথায় কালো পাগড়ি বাঁধা এই মানুষটি আসলে বোধহয় শিখিয়ে গিয়েছেন পর্দায় সত্যি কথা বলতে ৷ যে সত্যে তিনি বিশ্বাস করেন, যাঁকে তিনি ছুঁয়েছেন রোজ স্বপ্নে -জাগরণে তাই তিনি তুলে ধরেছেন ক্যানভাসে ৷ ঋত্বিক ঘটক বলতেন, সিনেমা তাঁর কাছে হাতিয়ার, সিনেমার প্রেমে তিনি পড়েননি ৷ একই কথা বোধহয় খাটে ঋতুপর্ণের ক্ষেত্রেও ৷ তাঁর কাছেও ছায়াছবি একটা হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
তাই চপল ভাদুড়ির জীবনকে ক্যামেরার সামনে তুলে ধরার সময় তিনি তাঁর পাশে দাঁড় করিয়ে দেন আরেকজন চিত্র পরিচালককে যিনি সমকামিতায় বিশ্বাসী ৷ তিনিই চপল ভাদুড়ির হাতটা ধরবেন ৷ ধরে বলবেন 'বনমালি তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা' ৷ 'মেমোরিজ ইন মার্চ' ছবিতেও দেখা যায় প্রেমিকের মৃত্যুর পর তাঁর মায়ের সঙ্গে প্রধান চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন ঋতুপর্ণ ৷ ঋতুপর্ণ ঘা মারেন এই সমাজের চেতনায় ৷ তাঁর ছবি কতবড় আন্দোলনের দলিল তা বোঝা যায় 'চিত্রঙ্গদা' ছবিতেও ৷ একজন সমকামী মানুষ তাঁর পরিবারেও কীভাবে এক ঘরে হয়ে পড়েন, সমাজের পর পরিবারেও তাঁকে কী ধরনের অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তারও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই ছবি ৷
আরও পড়ুন: আইপিএল ট্রফি ঘরে তুলল ইয়োলো আর্মি, রূদ্ধশ্বাস জয়ের সাক্ষী সারা ভিকি
ঋতুপর্ণ সবসময় সহমর্মিতা দেখিয়েছেন বঞ্চিতের জন্য ৷ তাঁর ছবির ফ্রেমে ফ্রেমে তিনি তাঁদের জিতিয়ে দিয়েছেন, যাঁরা বাস্তবে হারিয়ে যায় ৷ সমাজ যাঁদের একঘরে করে দূরে সরিয়ে দেয় - এটাই আসলে ঋতুপর্ণ ৷ রাশিয়ানরা বলতেন, ছবি তৈরি হবে সমাজের উন্নতির জন্য় ৷ তবে সেই সমাজের শুধু উন্নতি করার চেষ্টা করেননি ঋতুপর্ণ, বরং চেষ্টা করেছেন তাকে শিক্ষিত করার ৷