কলকাতা, 3 জানুয়ারি: মৃত্যুর চেয়ে বড় আর কিছুই নেই ৷ সেই অমোঘ মৃত্যুই মিলিয়ে দিয়েছে দুই কিংবদন্তিকে ৷ সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে একই আসনে বসেছেন সুমিত্রা সেন ৷ বছর আলাদা হলেও একইদিনে অমৃতলোকে পাড়ি দেন রবি ঠাকুরের গানের দুই কিংবদন্তি শিল্পী-সুচিত্রা এবং সুমিত্রা । শুধু বাঙালি নয়, বিদেশের রবীন্দ্রানুরাগীরাও পরিচিত এই নামদু'টির সঙ্গে । রবি ঠাকুরের গানে তাঁদের অনুভবী কণ্ঠ, সুর, ঋদ্ধ উচ্চারণ বরাবরই মুগ্ধ করেছে রবীন্দ্রানুরাগীদের ।
সুচিত্রা এবং সুমিত্রা- দু'টি নাম যেন দু'টি প্রতিষ্ঠান । রবীন্দ্র সঙ্গীতে নিজেদের একটা ঘরানা তৈরি করেছিলেন দু'জনেই । সেই ঘরানা আজও অনুসরণ করার চেষ্টা করেন বহু শিল্পী । আজ প্রয়াণ দিবসে তাঁদের দু'জনের জীবনের গল্প ফিরে দেখল ইটিভি ভারত।
কেমন ছিল এই দুই কিংবদন্তি শিল্পীর সম্পর্ক? সুমিত্রা সেনের কন্যা শ্রাবণী সেনের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম আমরা ৷ তিনি বলেন, "দু'জনের মধ্যে ভারী সখ্যতা ছিল। সুচিত্রা মিত্রের থেকে মা বেশ খানিকটা ছোট ছিলেন। মা খুব সম্মান করতেন তাঁকে। মাকে নিজের ছোট বোনের মতো গাইড করতেন । এমনকী শাসনও করতেন। দু'জনেই ছিলেন রবীন্দ্র ভারতীতে । তিনি (সুচিত্রা মিত্র) যখন রবীন্দ্রভারতীর রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রধান ছিলেন তখন মা ওঁর অধীনে কিছু দিন কাজও করেছেন । পরে মা নিজেও বিভাগীয় প্রধান হলেন । মায়ের হাতের রান্না খেতে খুব ভালোবাসতেন উনি। কী অদ্ভুত! দু'জনে চলেও গেলেন একই তারিখে ।"
1924 সালের 19 সেপ্টেম্বর এক চলন্ত ট্রেনের ভিতরে জন্ম হয় সুচিত্রা মিত্রর । 2011 সালের 3 জানুয়ারি সকল অনুরাগীদের স্তব্ধ করে দিয়ে থেমে যায় সেই পথ চলা ৷ শিল্পীর বাবা ছিলেন রামায়ণ-অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস ওঝার উত্তর পুরুষ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় । তিনিও ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক । মায়ের নাম সুবর্ণলতা দেবী । বাবা মায়ের চতুর্থ সন্তান সুচিত্রা মিত্রের জন্ম হয় ঝাড়খণ্ডের ডিহিরী জংশন লাইনে শালবন ঘেরা গুঝাণ্টি নামে একটি রেলস্টেশনের কাছে, ট্রেনের কামরায় । পৈতৃক ভিটে ছিল উত্তর কলকাতার ব্যস্ত অঞ্চল হাতিবাগানে ।
কলকাতার বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময়েই সঙ্গীত চর্চা শুরু সুচিত্রা মিত্রর। অমিতা সেন এবং অনাদিকুমার দস্তিদারের কাছে গানের প্রথম পাঠ নেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। খুব কম বয়স থেকেই শিখেছেন রবীন্দ্র সঙ্গীত । রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে । ছোটবেলায় একবার তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ পান । 1941 সালে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবন থেকে বৃত্তি লাভ করেন ।
কলেজে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি । মিছিল, মিটিং থেকে শুরু করে কাঁদানে গ্যাসের সম্মুখীন হওয়া-সবই রয়েছে তাঁর জীবনচরিতে । জানা যায়, গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন সুচিত্রা। সে সময় সলিল চৌধুরি থেকে শুরু করে দেবব্রত বিশ্বাসদের সঙ্গে গানও গাইতেন তিনি। তাঁর লেখা বেশ কিছু গানের বই সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের কাছে আকর হয়ে থেকে যাবে।
তিনি ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা শেরিফ । 1945 সালে সালে তিনি 'লন্ডন টেগোর হিম সোসাইটি' থেকে 'টেগোর হিম প্রাইজ' লাভ করেন । এরপর 1974 সালে তাঁকে 'পদ্মশ্রী' সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার । 1986 সালে ভারত সরকার তাঁকে 'সঙ্গীত নাটক আকাদেমি' পুরস্কার দেয় । এরপর একে একে এইচএমভি থেকে 'গোল্ডেন ডিস্ক পুরস্কার', বিশ্বভারতী থেকে 'দেশিকোত্তম', পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে 'আলাউদ্দিন পুরষ্কার' এসেছিল তাঁর ঝুলিতে। আরও পরে 'দহন' ছবিতে অভিনয়ও করেন সুচিত্রা মিত্র ।
রবি ঠাকুরের গানেই জীবন নিবেদন করেছিলেন সুমিত্রা সেনও । 1933 সালের 7 মার্চ জন্ম হয় তাঁর। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর, তাল, ছন্দে মেনেই এগিয়ে গিয়েছে তাঁর জীবন । কম বয়সেই 'গীতবিতান'-কে কাছে টেনে নিয়েছিলেন সুমিত্রা ৷ গান শেখার শুরু সেখান থেকেই । সঙ্গীতের পাঠ নেন 'বৈতানিক'-এও । তবে, গানের প্রথম পাঠ মায়ের কাছেই । পরবর্তীতে শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছেন অনাদি দস্তিদার, প্রদ্যুত নারায়ণ, সুরেন চক্রবর্তী, শ্রীমতি রাধারানি, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় এবং ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়দের ।
রবীন্দ্র সঙ্গীত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হওয়া থেকে 'এইচ এম ভি' থেকে 'লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড' প্রাপ্তি সব কিছুই খুব তাড়াতাড়ি ঘটেছিল তাঁর জীবনে । পাশাপাশি স্বামী অনিল সেনের প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'ত্রিবেণী'রও দেখভাল করেছেন শিল্পী। 2011 সালে নতুন সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে 11 জনের নতুন কমিটি গঠন করা হয় রবীন্দ্র সদনে । কমিটির শীর্ষে ছিলেন সুমিত্রা সেন । রবীন্দ্র সদন কমিটির শীর্ষে যাওয়ার পরই পুরনো দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসেন তিনি । দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকার পর 2023 সালের 3 জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় সুমিত্রার ।
আরও পড়ুন: