কলকাতা, 8 মার্চ : ব্রিগেড সমাবেশের 11 দিনের মাথায় আবারও বঙ্গসফরে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ সোমবারই প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রে এ কথা জানানো হয়েছে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে ৷ সূত্রের খবর, 18 এবং 20 মার্চ দক্ষিণবঙ্গের দুই জেলায় জনসভা করবেন মোদি ৷ প্রথম সভাটি হবে পুরুলিয়ায় ৷ দ্বিতীয়টির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিকে ৷ প্রসঙ্গত, পুরুলিয়া জেলার ন’টি বিধানসভা কেন্দ্রের সবকটি এবং কাঁথির অন্তর্গত দু’টি বিধানসভা আসনেই ভোট হবে প্রথম দফায়, আগামী 27 মার্চ ৷
আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে পুরুলিয়া বিজেপির তুরুপের তাস হতেই পারে ৷ কারণ 2018 সালে এই পুরুলিয়া থেকেই উত্থান শুরু হয়েছিল গেরুয়া শিবিরের ৷ সে বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের আবহে 29 মে নিখোঁজ হন তরুণ বিজেপি কর্মী ত্রিলোচন মাহাত ৷ সুপুরডি গ্রামের বাসিন্দা ওই যুবকের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় পরদিন 30 মে ৷ এর একদিন পরই 1 জুন নিখোঁজ হন আরও এক বিজেপি কর্মী ৷ ডাভা গ্রামের বাসিন্দা ওই যুবকের নাম দুলাল কুমার ৷ নিখোঁজ হওয়ায় দু’দিন পর 3 জুন উদ্ধার হয় দুলালের ঝুলন্ত দেহ ৷ দু’টি ঘটনাতেই নাম জড়ায় তৃণমূলের ৷ যদিও এখনও পর্যন্ত দোষীদের কাউকেই নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা যায়নি বা তাদের শাস্তি দেওয়া হয়নি ৷
এমন একটা আবহে পুরুলিয়ার মানুষ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির দিকে ঝুঁকতে শুরু করে ৷ যার সরাসরি প্রভাব পড়ে উনিশের লোকসভা নির্বাচনে ৷ তৃণমূলের হাত থেকে জেলার একমাত্র লোকসভা আসনটি ছিনিয়ে নেয় বিজেপি ৷ মৃগাঙ্ক মাহাতর জায়গায় নতুন সাংসদ হন জ্যোতির্ময় সিং মাহাত ৷ উনিশের লোকসভা ভোটের হিসাব অনুসারে, পুরুলিয়া জেলার মোট ন’টি (পুরুলিয়া, জয়পুর, কাশীপুর, বাঘমুণ্ডী, বলরামপুর, মানবাজার, বান্দোয়ান, রঘুনাথপুর ও পাড়া) বিধাসভা আসনের মধ্যে কেবলমাত্র মানবাজার বাদে বাকি সবক’টিতেই এগিয়ে রয়েছে বিজেপি ৷ অথচ 2016 সালের ভোটে এই ন’টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে সাতটিতেই জিতেছিল তৃণমূল ৷ বাকি দু’টি ঝুলিতে পুরেছিল কংগ্রেস ৷
আরও পড়ুন : বিনামূল্যে গ্যাস দিয়ে দেখাক মোদি সরকার, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন মমতা
কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একেবারে আলাদা ৷ মনে করা হচ্ছে, পশ্চিমের রুখা-শুখা এই জেলায় এবার পদ্মের চাষই জমবে ৷ ইতিমধ্যে বিজেপি যে প্রার্থীতালিকা ঘোষণা করেছে, সেই অনুযায়ী, কেবলমাত্র দু’টি আসন ছাড়া বাকি সাতটিতেই প্রার্থী নিয়ে বড় কোনও জটিলতা নেই ৷ যে আসন দু’টি নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে একটি হল বাঘমুণ্ডী ৷ যেটি আজসু (অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন)-কে ছেড়ে দিয়েছে বিজেপি ৷ দলের এই সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি নয় বিজেপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা ৷ তাঁরা চান, ওই আসনে এলাকারই কোনও প্রতিনিধিকে দাঁড় করাক দল ৷
অন্যদিকে, যে বলরামপুর থেকে বিজেপির উত্থান শুরু, ঝামেলা বেধেছে সেখানেও ৷ এই আসনটিতে প্রার্থী হিসাবে বাণেশ্বর মাহাতর নাম ঘোষণা করেছে বিজেপি নেতৃত্ব ৷ অথচ বাণেশ্বরের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ রয়েছে দলেরই একটা বড় অংশের ৷ তাঁরা চাইছেন বাণেশ্বরের বদলে সুযোগ দেওয়া হোক স্বচ্ছ ভাবমূর্তির গোপীনাথ গোস্বামীকে ৷
এছাড়া, কাশীপুর কেন্দ্রে এখনও কোনও প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি গেরুয়াশিবির ৷ মনে করা হচ্ছে বিকল্প কাউকে না পেলে এই আসনে প্রার্থী করা হতে পারে দলের জেলা সভাপতি বিদ্য়াসাগর চক্রবর্তীকে ৷
এই অবস্থায় আগামী 27 মার্চ ভোট হলে বিজেপির পাল্লা ভারী থাকবে বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের ৷ ফল নিয়ে আশাবাদী জেলার তৃণমূলস্তরের কর্মীরাও ৷ প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন পুরুলিয়া সফর নিয়ে উচ্ছ্বসিত তাঁরা ৷ বিজেপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনুমান, মোদির সভার পর জেলায় বিজেপির প্রতি মানুষের ভরসা আরও বাড়বে ৷ কাজ করার বাড়তি উৎসাহ পাবেন দলের নিচুতলার কর্মীরাও ৷ তবে একইসঙ্গে ইতিউতি যে দু-একটা কোন্দল দেখা দিয়েছে, সেগুলোরও সমাধান করতে হবে ৷
মোদির আসন্ন বঙ্গসফরের পরবর্তী গন্তব্য পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি ৷ স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের ময়নাতদন্ত বলছে, এখানকার প্রেক্ষাপট পুরুলিয়ার একেবারে উল্টো ৷ এমনকী, শুভেন্দু অধিকারীর দলবদল নিয়ে প্রথমে বেশ হাওয়া গরম হলেও এখন সেই হাওয়াই বইছে উল্টো দিকে ৷ কাঁথিতে বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে দু’টি ৷ কাঁথি উত্তর এবং কাঁথি দক্ষিণ ৷ 2016 সালের নির্বাচনে এই দু’টোই ছিল মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের তৃণমূলের দখলে ৷ কাঁথি উত্তরে জিতেছিলেন বনশ্রী মাইতি এবং কাঁথি দক্ষিণে জয় এসেছিল শুভেন্দুর ভাই দিব্য়েন্দুর ঝুলিতে ৷ পরবর্তীতে তমলুকের সাংসদ হন দিব্য়েন্দু ৷ ফলে ছাড়তে হয় বিধায়ক পদ ৷ 2017 সালের উপনির্বাচনে দিব্য়ন্দুর জায়গায় আসেন তৃণমূলেরই চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ৷
আরও পড়ুন : ঘাসফুলে টিকিট না পেয়ে পদ্মশিবিরে একঝাঁক নেতা
এবছর কাঁথি উত্তর ও কাঁথি দক্ষিণ আসনে তৃণমূলের দুই প্রার্থী হলেন যথাক্রমে তরুণ জানা এবং জ্য়োতির্ময় কর ৷ এই তরুণ জানা এক সময় শুভেন্দু অধিকারীর ঘনিষ্ঠ হলেও এখন তা অতীত ৷ বরং ইদানীং তৃণমূলে তাঁর ওজন বেড়েছে ৷ সদ্য গঠিত পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কোর কমিটির সদস্যপদও পেয়েছেন তরুণ ৷ অন্যদিকে, জ্য়োতির্ময় কর তৃণমূলেরই পটাশপুরের বিদায়ী বিধায়ক ৷
লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, কাঁথি উত্তরের বিদায়ী বিধায়ক বনশ্রী মাইতি ইতিমধ্যেই শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে বিজেপিতে যোগদান করেছেন ৷ কিন্তু গেরুয়াবাহিনী তাঁকে টিকিট দেয়নি ৷ বদলে প্রার্থী হয়েছেন কাঁথি পুরসভার 9 নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর সুনিতা সিনহা ৷ বিজেপিতে তাঁর যোগদানেরও কাণ্ডারী ছিলেন সেই শুভেন্দুই ৷ অন্যদিকে, কাঁথি দক্ষিণ আসনে বিজেপির দাঁও অরূপকুমার দাস ৷
তথ্যাভিজ্ঞ মহল বলছে, কাঁথির দু’টি আসনেই জেতার সম্ভাবনা রয়েছে তৃণমূলের ৷ কারণ, শুভেন্দু অধিকারীর দলবদলের আগে যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে বিজপিতে এসেছিলেন, তাঁদের ক্ষোভের কারণ ছিল অধিকারী পরিবার ৷ এখন বিজেপিতেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই অধিকারী বাড়িই মেজো ছেলে ৷ যা মেনে নিতে পারছেন না বিজেপির নিচুতলার স্থানীয় কর্মীরা ৷ এমনকী, ভোটারদের উপরও এর একটা প্রভাব পড়েছে ৷
এই অবস্থায় কাঁথিতে মোদির একটা সভা সবকিছু বদলে দেবে, তেমনটা মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ৷ বরং তাঁদের মতে, নন্দীগ্রামের প্রার্থী হওয়ায় মমতার কাঁথি-সহ আশপাশের এলাকায় প্রচারের সুযোগ অনেক বেশি ৷ যার সুফল পাবে গোটা দল ৷