দার্জিলিং, 25 আগস্ট : দার্জিলিং আর টয়ট্রেন ৷ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা দুটি জিনিস ৷ যা একে অপরের সমার্থক বললেও খুব একটা ভুল হয় না ৷ দার্জিলিং গেছেন অথচ টয়ট্রেন চাপেননি এমন লোক প্রায় নেই বললেই চলে ৷ পুরোনো দিন থেকে আজ ৷ বারবার বাংলা ও হিন্দি ছবিতে দেখা গিয়েছে টয়ট্রেনের দৃশ্য ৷ বহু দূরদূরান্ত থেকে অনেক পর্যটকই পাহাড়ে আসেন টয়ট্রেনের টানে ৷
পাহাড় থেকে সমতল ৷ ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তি তো বটেই, তথা গোটা বাংলার কাছেই টয়ট্রেন এক ঐতিহ্যবাহী জিনিস, এক আবেগ ৷ যা একান্তই বাংলার নিজের ৷ তবে এই টয়ট্রেনকেই এবার বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ৷ আর স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা বাংলা ৷
ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন প্রকল্পের অধীনে সড়ক থেকে বন্দর, রেল থেকে বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ থেকে কয়লার মতো দেশের সম্পদগুলিকে বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্র । আর এই পাইপলাইন প্রকল্পের অধীনেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী টয়ট্রেনের তত্ত্বাবধায়ক দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে । টয়ট্রেনের বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তে পর্যটন মহল থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সকলেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ।
আরও পড়ুন : Darjeeling Toy Train : অপেক্ষা শেষ, 3 দিন পরই শিলিগুড়ি ছেড়ে পাহাড়ে উঠবে টয়ট্রেন
কেউ বেসরকারিকরণের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আবেদন জানিয়েছেন, আবার কেউ এর প্রতিবাদে সক্রিয় আন্দোলনে নামার হুমকিও দিয়েছেন । সকলের উদ্দেশ্য একটাই ৷ টয়ট্রেনের বেসরকারিকরণ বন্ধ করা ৷
টয়ট্রেন বেসরকারিকরণ হলে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগে রয়েছে পর্যটনমহল । একেই করোনার জেরে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল টয়ট্রেন পরিষেবা । সেই ক্ষতিই কীভাবে কাটিয়ে উঠবে তাই ভেবে পাচ্ছে না পর্যটনমহল ৷ সবেমাত্র একটু ধাতস্থ হয়ে ফের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার স্বপ্ন দেখা শুরু করতেই কেন্দ্রের মানিটাইজেশন পাইপলাইন প্রকল্পে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের নাম ঢুকে যাওয়ায় ঘুম উড়েছে পর্যটনমহলের ।
কেন্দ্রীয় সরকারের ওই সিদ্ধান্তে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে তা প্রত্যাহার করার আবেদন জানিয়েছে পর্যটনমহল । বেসরকারিকরণ হলে টয়ট্রেন তার হেরিটেজ তকমা আর ধরে রাখতে পারবে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে । তবে ইউনেস্কোর (UNESCO) শিরোপা পাওয়ার পরেও কি সরকার হেরিটেজ সম্পদের বেসরকারিকরণ করতে পারে ? তা নিয়েও উঠছে একাধিক প্রশ্ন ৷
আরও পড়ুন : Darjeeling Toy Train: ভিস্তা ডোম কোচ থেকে পাহাড় দর্শন, দার্জিলিংয়ে ফের চালু হচ্ছে টয়ট্রেন
এই বিষয়ে রাজ্যের প্রাক্তন পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, "খুবই দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত । টয়ট্রেনের সঙ্গে দার্জিলিং ও বাংলা তথা এই দেশের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে । এর বেসরকারিকরণ হওয়ার পর তা সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে চলে যাবে । দেশের নবরত্নকে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার এই তুঘলকি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে ।"
শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সৌরভ চক্রবর্তীর কথায়, "দেশে তালিবানি শাসন চলছে । এই সরকার সব কিছু বিক্রি করতে এসেছে । এর আগে রেল, বিএসএনএল এর মতো সংস্থা বিক্রি করেছে । এবার টয়ট্রেন বিক্রি করে দিচ্ছে ।"
প্রাক্তন গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের চেয়ারম্যান অনিত থাপা জানান, টয়ট্রেনের বেসরকারিকরণের বিষয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে রয়েছে গোটা পাহাড়বাসী । আমাদের দেশের সম্পদ এবং পরিকাঠামো লুট করা হচ্ছে ।
আরও পড়ুন : দার্জিলিংয়ে চালু টয়ট্রেনের জয় রাইড, খুশির হাওয়া পর্যটন শিল্পে
অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজার্ভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজমের আহ্বায়ক রাজ বসু বলেন, "দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েকে বেসরকারিকরণ করলে তার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে । এমনিতেই টয়ট্রেন খুব একটা ভাল পরিস্থিতিতে নেই । এরপর বেসরকারিকরণ করলে যে সংস্থা নেবে সে কীভাবে পরিচালনা করবে তা নিয়েও ধন্দ্ব রয়েছে । এর ফলে পর্যটনও খুব বড় ধাক্কা খাবে ।"
হিমালয়ান হসপিটালিটি ট্রাভেল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের কার্যকরী কমিটির সদস্য জয়ন্ত মজুমদারের কথায়, "কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত । কারণ টয়ট্রেনের সঙ্গে উত্তরের পাশাপাশি গোটা রাজ্যের পর্যটন জড়িয়ে রয়েছে । কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত যেভাবেই হোক দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েকে নিজেদের অধীনে রাখা । এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে সমস্ত পর্যটনমহল কেন্দ্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে ।"
যদিও এই বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেছেন ইন্টার্ন হিমালয়ান ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেবাশিস মৈত্র ৷ বেসরকারিকরণের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, "বেসরকারিকরণ হলেও সেক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা হবে না । উলটে টয়ট্রেন পরিষেবার মান উন্নয়ন হবে বলে মনে হয় আমার । এর আগে কেন্দ্র এবং রাজ্যের অনেক ক্ষেত্রেই বেসরকারিকরণ হয়েছে ।"
আরও পড়ুন : দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেনে গুগলের বিজ্ঞাপনের শুটিং