কালিম্পং, 15অগস্ট : সালটা 1984 ৷ স্থানীয় দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে একদিন গাছের চারা নিতে আসে কালিম্পংয়ের একটি দুর্গম পাহাড়ের মাঝে ৷ চারা নেওয়ার জন্য গাছ কাটতেই হঠাৎ একটি আওয়াজ ভেসে আসে ৷ কেউ যেন করুণ আকুতি জানিয়ে বলছে, "আমায় কেটো না, এখান থেকে আমায় কেটে ফেলো না" ৷ মেয়েটি বন্ধুদের মজা ভেবে সে কথাই কর্ণপাত না করে ফের গাছ কাটতে শুরু করে ৷ এমন সময় তার পায়ের তলার মাটি কাঁপতে থাকে ৷ ভূমিকম্প হচ্ছে ভেবে সে এদিক ওদিক দেখতে থাকে কেউ আছে কিনা ৷ সেই মুহূর্তেই হঠাৎ তার সামনে এক প্রকাণ্ড জ্যোতির্লিঙ্গ প্রকট হয়ে ওঠে ৷ যার চুলগুলো যেন এক একটি বিশাল সাপ, যারা অনবরত ফণা তুলে জিভ বের করছে ৷ চোখের সামনে এই সব দেখে এবং জ্যোতির্লিঙ্গের প্রবল তেজে সেখানেই মেয়েটি জ্ঞান হারায় ৷
এদিকে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও চারা নিয়ে না ফেরায় বন্ধুরা তাকে খুঁজতে থাকে ৷ এরপর সেখানে পৌঁছে তারা দেখে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে ৷ তৎক্ষণাৎ তার চোখে মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করার পর তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে ৷ বেঘোরে তিন-চারদিন এভাবে থাকার পর যখন তার একটু জ্ঞান আসে, তখন তার মুখ থেকেই উপরোক্ত কাহিনী জানতে পারে সবাই ৷ জানার পর সবাই সেখানে গিয়ে একটি ছোট শিবলিঙ্গ দেখতে পান ৷
তখন থেকেই শুরু হয় পূজার্চনা, তৈরি হয় মন্দির ৷ আগে এলাকাটি সম্পূর্ণ বন-জঙ্গলে ঘেরা থাকলেও এখন সেসব নেই ৷ সেই মেয়েটিরও এখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে ৷ লোকমুখে শিবলিঙ্গের এই মাহাত্ম্য প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই বেড়েছে ভক্ত সমাগম ৷ নেপাল, ভুটান, অসম, ডুয়ার্স প্রভৃতি বহু দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ভক্ত ও দর্শনার্থীরা আসেন ৷
আরও পড়ুন : বাস নয়, বাসা
আশ্চর্যজনকভাবে এখানে মন্দিরের ভিতরে থাকা একটি চূড়া থেকে সারা বছর জল পড়ে শিবলিঙ্গের মাথায় ৷ চূড়াটির গায়ে রয়েছে বাঘের ছালের মতো ছাপ ৷ দেখলে মনে হবে বাঘের ছাল জড়ানো রয়েছে শিবলিঙ্গে ৷ যা সাধারণত দেখা যায় না ৷ চারিদিকে দুর্গম পাহাড়ের মাঝ থেকে সাদা লাল রঙের মন্দিরটির দেখা মেলে । কালিম্পং শহর থেকে বেশি দূরে নয় বার্মেকের বিখ্যাত এই ঐতিহাসিক মন্দির । স্বয়ং মহাদেব দর্শনের কাহিনী শোনার পর পাহাড়ের গা ঘেঁষে নির্মিত হয় মন্দিরটি । সারা বছর তো বটেই বিশেষ করে শ্রাবণ মাসে পুণ্যার্থীদের ভিড় উপচে পড়ে এখানে । শিবলিঙ্গের কাছাকাছি সাপের ঘোরাফেরা করার ছবিও একবার ধরা পড়েছে সিসিটিভিতে ৷
উত্তরবঙ্গে এই একটিই মহাদেব ধাম রয়েছে বলে জানান মন্দির কমিটির সম্পাদক শুকমান গুরুং ৷ তবে সারা বছর পুণ্যার্থী এবং পর্যটকদের ভিড় থাকা সত্ত্বেও সরকারের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা মেলে না ৷ তাই তাঁরা চাইছেন, যাতে সরকারিভাবে এই মন্দিরকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে সংরক্ষণ করা হোক ৷ প্রশাসন বা রাজ্য সরকার সহযোগিতা করলে এই ধামটি একটি ধর্মীয় পীঠস্থান হিসেবে পর্যটকদের জন্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি ৷
আরও পড়ুন : দিঘায় প্রবল জলোচ্ছ্বাস, উচ্ছ্বসিত পর্যটক
মহাদেব ধামটির সংরক্ষণের জন্য সরকার বা জেলা প্রশাসন যাতে এগিয়ে আসে তার দাবি জানাচ্ছেন স্থানীয়রাও । সরকারের যথাযথ সুরক্ষার মাধ্যমে এই মহাদেব ধামকে ধর্মীয় পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে বলে মত এখানকার পর্যটন ব্যবসায়ীদের । এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে এলাকার আর্থ সামাজিক উন্নয়ন হবে বলে আশা তাঁদের ।
এই মন্দিরের পুরোহিত গৌরীশঙ্কর শর্মা বলেন, "সারা বছরই দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে মন্দিরে । মন্দিরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থাকায় বহু দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন এখানে ।"
এই বিষয়ে হিমালয়ান হসপিটালিটি ট্রাভেল ডেভলপমেন্ট নেটওয়ার্কের সম্পাদক সম্রাট সান্যাল বলেন, "এই ধরনের ঐতিহাসিক মাহাত্ম্য সমৃদ্ধ ধর্মীয় পীঠস্থান নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে আলাদা চাহিদা থাকে । প্রশাসন সহযোগিতা করলে অবশ্যই এটিকে একটি ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব ।"
মন্দিরে পৌঁছানোর পথ নির্দেশ : শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং শহরে পৌঁছে গাড়িতে ডম্বরচক ৷ ডম্বরচকের মোটর স্ট্যান্ড থেকে ফের গাড়িতে প্রায় 14 কিমি দূরে গরুবাথান ৷ এরপর চড়াই-উতরাই 2 কিমি পথ হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন মন্দিরে ৷