মালদা, ১৬ মার্চ : "উপাচার্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছেন। উনি যে কোনও উপায়ে আমার সম্মানহানির চেষ্টা করছেন। আমার ভবিষ্যৎ শেষ করার চেষ্টা করছেন।" রাতের অন্ধকারে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইল লোপাটের চেষ্টায় অভিযুক্ত এক অধ্যাপক গতকাল উপাচার্যের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলেন। যদিও এনিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি উপাচার্য। তবে গতকাল সন্ধ্যায় এনিয়ে ইংরেজবাজার থানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অভিযুক্ত অধ্যাপক একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগ, পরশুরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলমারি থেকে রুশার (RUSA) ফাইল লোপাট করতে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন রসায়ন বিভাগের এক ছাত্র। নিরাপত্তারক্ষীরা ওই ছাত্রকে ধরে রেখে খবর দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারকে। কিন্তু রেজিস্ট্রার পরশু মালদার বাইরে ছিলেন। তিনি গোটা বিষয়টি উপাচার্য স্বাগত সেনকে জানান। খবর পেয়ে রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যান উপাচার্য। খবর দেওয়া হয় ইংরেজবাজার থানায়। পুলিশের উপস্থিতিতে ফাইলটি নিজের হেপাজতে নেন উপাচার্য। তাঁর অভিযোগ, এই ঘটনার পিছনে রসায়ন বিভাগের এক অধ্যাপকের হাত রয়েছে। নাম না করলেও বোঝা যায় অভিযোগের তির রসায়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সৌগত পালের দিকে।
গতকাল উপাচার্য জানান, "ঘটনাটি পরশু রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ। গত ১২ মার্চ আমরা একটি চিঠি পাই। ওই চিঠিতে সম্ভবত রসায়ন বিভাগেরই কোনও ছাত্র জানান, ওই বিভাগে মাঝরাত পর্যন্ত লোকজন থাকছে। সেখানে অসামাজিক কাজকর্ম হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এদিকে নিরাপত্তারক্ষীরাও জানায়, অনেক রাতে কিছু মানুষ কিছু ফাইল ভরতি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিরাপত্তারক্ষীদের জানিয়ে দিই, রাতে সন্দেহজনক কেউ ব্যাগ নিয়ে বেরোলে তারা যেন সেই ব্যাগ পরীক্ষা করে দেখে। গতকাল রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ নিরাপত্তারক্ষীরা জানায়, এক ছাত্র একটি ব্যাগ ভরতি ফাইল নিয়ে যাচ্ছিল। নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে ফাইল দেখাতে বললে সে ফাইল দেখায়। তারপর সেসব নিয়ে ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে চলে যায়। ওই ছাত্র হয়ত রসায়ন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। ওই বিভাগের এক অধ্যাপকও রাতে তাঁর কক্ষে ছিলেন। এই খবর পেয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। আসেন কিছু অধ্যাপক অধ্যাপিকাও। আমরা সবাই দেখি, একটি ফাইল ওই অধ্যাপকের ঘরের দরজার কোনে পড়ে রয়েছে। ওই অধ্যাপক একসময় রুশার আহ্বায়ক ছিলেন। সেই সময় তাঁর কাছে থাকা সমস্ত ফাইল তাঁকে ১৩ মার্চের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু তিনি সেদিনের মধ্যে সব ফাইল জমা দিতে পারবেন না বলে রেজিস্ট্রারকে মেইল করেন। কিন্তু তার পরদিন রাত সাড়ে ১০টার সময় যদি কেউ কোনও ফাইল নিয়ে বেআইনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যায়, তবে তা কাম্য নয়। এই ঘটনার পর গতকাল আমরা সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানায় জানাই। পুলিশের উপস্থিতিতে ওই অধ্যাপকের ঘর থেকে পাওয়া ফাইলটি সিল করা হয়। ঘটনার তদন্তের জন্য আমি একটি কমিটিও গঠন করেছি।" উপাচার্য আজ আরও বলেন, "উপাচার্য পরিবর্তনের সময় রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে উধাও হয়ে যাওয়া আরও অনেক ফাইল এখনও পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার সঙ্গে পুরোনো সেই ঘটনার কোনও যোগ রয়েছে কী না সেটাও আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। এমনও হতে পারে, এখনও পর্যন্ত যে ফাইলগুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেসব রুশা সংক্রান্ত রেজিস্ট্রার দপ্তরের ফাইল। পূর্বতন উপাচার্যের আমলে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশা সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। যে কারণে রুশা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়। এখনও আমাকে তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অর্থের অভাবে আমরা অনেককে প্রাপ্য টাকা দিতে পারছি না।"
এদিকে উপাচার্যের তির যে অধ্যাপকের বিরুদ্ধে, তিনি রসায়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সৌগত পাল। সৌগতবাবুর দাবি, "আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে UG CBCS (choice based credit system) চালু হয়েছে৷ গতকাল সন্ধে ৭-৭.৩০ নাগাদ আমি এক স্কলারের সঙ্গে সেই স্কিম নিয়েই কাজ করছিলাম। ওই স্কিমে সিলেবাস পরিবর্তনের কাজ চলছিল। সাড়ে ৭টা নাগাদ আমরা সবাই চা খেতে যাই। চা খাওয়ার পর আমি ছাত্রকে বলি, আজ আর কাজ করব না। রাতে বাড়িতে বাকি কাজটা করব। আমি তাকে আমার ল্যাপটপটা বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলি। আমি তাকে একথা বলে বাড়ি চলে যাই। এই রিসার্চ যদি অসামাজিক কাজের মধ্যে পড়ে তাহলে সেটা আমার জানা নেই। আর মাঝরাত পর্যন্ত বিভাগে কাজ চলার যে কথা বলা হচ্ছে সেটা শুধুমাত্র অভিযোগ। আমি জানি না একথা উনি কেন বলছেন। তবে উনি যে এসব কেন বলছেন তা আমার কাছে পরিষ্কার। উনি যে কোনও উপায়ে আমার সম্মানহানি করার চেষ্টা করছেন। আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাইছেন। উপাচার্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছেন। উনি যা করবেন, সেটাই সবাইকে মেনে নিতে হবে। কোনও কথা বলা যাবে না। কোনও ছাত্রের হাত দিয়ে ফাইল বাইরে যাওয়া আর বই বাইরে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। পরশু আমি একাধিকবার আমার ল্যাপটপের ব্যাগ তল্লাশি করার জন্য আবেদন করেছি। পুলিশের সামনেই সেই আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু আমার আবেদনে সাড়া দেওয়া হয়নি। রিসার্চের বাইরে আমার ছাত্ররা কোনও ফাইলে হাত দেয় না। কিন্তু যা হয়েছে, আমি মনে করি তা চরম অনৈতিক। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক উপাচার্য, তাই এই অনৈতিক কাজের দায় তাঁকেই নিতে হবে।"
গোটা ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যায় সৌগতবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট অফিসার রাজীব পুততুণ্ডর। একই সময় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন অধ্যাপক সৌগত পালও। পুলিশ জানিয়েছে, দুটি অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করা হচ্ছে।