মালদা, 20 সেপ্টেম্বর : পরিশ্রুত পানীয় জলপ্রকল্প চালুর উদ্যোগ শুরু হয়েছিল 2003 সালে ৷ পরিকাঠামোর বেশিরভাগটাই তৈরি হয়ে গিয়েছে পাঁচ বছর আগে ৷ কিন্তু এখনও মালদা শহরের মানুষ আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডমুক্ত পানীয় জল পাননি ৷ এদিকে, এই শহরের ভূগর্ভে থাকা জলস্তরে মিশে রয়েছে ওই দুই বিষ ৷ কিন্তু, উপায় না থাকায় সেই জলই পান করে চলেছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শহরবাসী ৷ আর্সেনিকোসিসের প্রভাবে এক সময় উজাড় হয়ে গিয়েছিল মানিকচকের শেখপুরা গ্রামের একাংশ ৷ মালদা শহরে এখনও সেই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়নি ৷ কিন্তু, যেকোনও মুহূর্তে ছবিটা বদলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা শহরবাসীর ৷ তাই এখন চড়া দামে পানীয় জল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন শহরবাসী ৷ তাঁদের দাবি, যতদিন না পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের প্রকল্প চালু হচ্ছে, ততদিন অন্তত শহরে ‘বিষমুক্ত’ জল সরবরাহের ব্যবস্থা করুক সরকার ৷
আরও পড়ুন : বালুরঘাটের জল সমস্যা মেটাতে একাধিক পদক্ষেপ মন্ত্রী সাবিনার
153 বছরের পুরোনো ইংরেজবাজার পৌর এলাকার (মালদা শহর এই পৌরসভারই অন্তর্গত) মোট আয়তন 13.25 বর্গকিলোমিটার ৷ 2011 সালের জনশুমারি অনুযায়ী, পৌর এলাকার বাসিন্দাদের সংখ্যা 2 লক্ষ 16 হাজার 83 জন ৷ কিন্তু পৌরসভা সূত্রে খবর, এই মুহূর্তে শহরে প্রায় 4 লক্ষ মানুষ বসবাস করেন ৷ বর্তমানে পৌরসভার 76টি পাম্প দিয়ে 29টি ওয়ার্ডে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করে সরবরাহ করা হয় ৷ কিন্তু, সেই জল শোধন করা হয় না ৷ ফলে আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডযুক্ত জলই পৌঁছে যায় শহরবাসীর ঘরে ৷ উপরন্তু, অবৈজ্ঞানিক উপায়ে ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়ায় জলস্তরও ধীরে ধীরে নীচে নেমে যাচ্ছে ৷ যা আগামী দিনে জলসঙ্কট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা ওয়াকিবহাল মহলের ৷
পরিশ্রুত পানীয় জলপ্রকল্পের জন্য 2003 সালে 42 কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় ৷ তখন ঠিক হয়েছিল, গঙ্গা থেকে পাইপলাইনে শহরে জল নিয়ে আসা হবে ৷ শহরেই তৈরি হবে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ৷ কিন্তু সেই প্রকল্প আর দিনের আলো দেখেনি ৷ পরবর্তীতে জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশনের তরফে নতুন প্রকল্পের জন্য প্রথম পর্যায়ে 41 কোটি টাকা বরাদ্দ হয় ৷ পরে প্রকল্প বরাদ্দ বেড়ে হয় প্রায় 104 কোটি টাকা ৷ তৎকালীন পৌরপ্রধান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পটির অনুমোদন দিয়েছিল ৷ 2011 সালে তাঁরই তত্ত্বাবধানে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ ৷ 2016-17 সালের মধ্যে শহর লাগোয়া নিমাসরাইয়ে মহানন্দা নদীর উপর ইনটেক পয়েন্ট তৈরি করা হয় ৷ সেখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কোতওয়ালি গ্রাম পঞ্চায়েতের দৈবকীপুরে তৈরি হয় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ৷ গোটা শহরে পাঁচটি ওভারহেড রিজার্ভারও তৈরি করা হয়েছে ৷ সঙ্গে রয়েছে আরও তিনটি পুরনো ওভারহেড ওয়াটার রিজার্ভার ৷ নদী থেকে প্লান্ট পর্যন্ত 6 হাজার 300 মিটার পাইপলাইনের কাজও শেষ ৷ এছাড়া, ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থেকে প্রতিটি রিজার্ভার পর্যন্ত বসানো হয়েছে আরও 17 হাজার 300 মিটার পাইপলাইন ৷ সব মিলিয়ে 1 লক্ষ 34 হাজার 800 মিটার ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইনের মধ্যে প্রায় 84 শতাংশেরই কাজ শেষ হয়েছে ৷ বাকি রয়েছে সামান্য কিছু কাজ ৷ বিরোধীদের অভিযোগ, এইভাবেই এই প্রকল্পকে ইচ্ছে করে ঝুলিয়ে রেখেছে রাজ্যের শাসকদল ৷ যাতে প্রতি ভোটে এই প্রকল্পকে তারা ইস্যু করতে পারে।
আরও পড়ুন : শিলিগুড়িতে পানীয় জলের অপচয় রুখতে স্টপকক বসালেন বিধায়ক
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন বিজেপির জেলা সভাপতি গোবিন্দচন্দ্র মণ্ডল ৷ তাঁর অভিযোগ, ‘‘সবই হয়েছে, কিন্তু মালদা শহরের মানুষ পরিশ্রুত পানীয় জল পাননি ৷ আসলে এই প্রকল্প তৃণমূলের নির্বাচনী এজেন্ডা ৷ প্রতি ভোটে এই প্রকল্পকে ইস্যু করে ওরা ভোট চায় ৷ তার সঙ্গে রয়েছে পকেটে টাকা ভরার কৌশল ৷ এটা নোংরা রাজনীতি ৷’’
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কৌশিক মিশ্র বলেন, “ইংরেজবাজার পৌরসভায় দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল ৷ পুরাতন মালদা ও এই পৌরসভায় একই সময় শুরু হওয়া প্রকল্পে পাশের পৌরসভায় কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ সেখানকার মানুষ এখন বাড়িতেই পরিশ্রুত পানীয় জল পাচ্ছেন ৷ সেখানে বাম বোর্ড ছিল ৷ কিন্তু এখানে সেটা এখনও চালু হয়নি ৷ অথচ প্রকল্পের সবকিছুই প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছে ৷ কয়েকদিন আগেই আমরা এ নিয়ে পৌর প্রশাসককে ডেপুটেশন দিয়েছি ৷ তিনি ভরসা দিয়েছেন ৷ কিন্তু আমরা ভরসা করতে পারছি না ৷ এর দায় ও দায়িত্ব তৃণমূলের ৷ এই প্রকল্প এখন শাসকদলের ভোটের ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷”
নির্দিষ্ট সময়ে এই প্রকল্প চালু করতে তাঁরা যে ব্যর্থ তা মেনে নিয়েছেন পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা ইংরেজবাজার শহর তৃণমূলের সভাপতি নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারি ৷ তিনি বলেন, “আমরা যে সময়মতো শহরবাসীকে আর্সেনিকমুক্ত পরিশ্রুত পানীয় জল দিতে পারিনি, তা স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই ৷ টেকনিক্যাল কিছু সমস্যায় এই প্রকল্প চালু করা যায়নি ৷ সেসব সমস্যা মিটে গিয়েছে ৷ খুব তাড়াতাড়ি এই প্রকল্প চালু করা হবে ৷’’
আরও পড়ুন : সোনারপুরে পরিশ্রুত পানীয় জল প্রকল্পের উদ্ধোধন লাভলির
বিধানসভা নির্বাচনে এই পৌর এলাকায় শাসকদলের যে ভরাডুবি হয়েছে তা বিলক্ষণ জানেন ইংরেজবাজার পৌরসভার প্রশাসক সুমালা আগরওয়াল। সেকথা মাথায় রেখেই এনিয়ে তাঁর সতর্ক মন্তব্য, “মাত্র একমাস হল আমি দায়িত্ব পেয়েছি ৷ যেদিন এই আসনে বসেছি, তার পরের দিনই এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে কাজ শুরু করেছি ৷ একটা কথা বলতে পারি, আসন্ন পৌর নির্বাচনে এটা আর কারও ইস্যু থাকবে না ৷’’