মালদা, 13 জুলাই : মানিকচক ব্লকের গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বালুটোলায় অস্থায়ীভাবে ভাঙন রোধের কাজ শুরু করার নির্দেশ দিলেন সেচ দফতরের প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন (Sabina Yeasmin) । তিনি জানিয়েছেন, গঙ্গার গ্রাস থেকে বালুটোলাকে বাঁচাতে আপাতত তিনটি পয়েন্টে ভাঙন রোধের কাজ করা হবে । আগামী বর্ষার আগেই এখানে স্থায়ী ভাঙন রোধের কাজ করার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি । মঙ্গলবার দুপুরে সেচ দফতরের সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার, মানিকচকের বিডিও, থানার আইসিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অল্প সময়ের জন্য বালুটোলা গ্রামের গঙ্গা ভাঙন পরিদর্শন করেন ।
মালদা জেলায় সাধারণত অগস্ট মাসে পাড়ে ছোবল মারতে শুরু করে গঙ্গা । কিন্তু এবার বর্ষা মরশুম শুরু হতেই গঙ্গার তাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে । কালিয়াচক-3 নম্বর ব্লকের বীরনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের লালুটোলার সঙ্গে এবার গঙ্গার নিশানায় মানিকচকের বালুটোলা । প্রায় 20 দিন ধরে লাগাতার ভাঙনে অন্তত আড়াইশো বিঘা কৃষিজমি নদীগর্ভে চলে গিয়েছে । এখনও প্রতিনিয়ত পাড় কাটছে গঙ্গা । পরিস্থিতি বুঝে নদী থেকে সামান্য দূরে থাকা ঘরবাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন একাংশ গ্রামবাসী ৷ এই মুহূর্তে নদী থেকে বাঁধের দূরত্ব 200 মিটারও নয় । এলাকার সবার আর্জি, গঙ্গার স্থায়ী ভাঙন রোধের কাজ করুক সরকার । তা না হলে যে কোনও সময় বালুটোলা গ্রামটিই গঙ্গায় চলে যাবে । বাঁধ ভেঙে গেলে বিপন্ন হয়ে পড়বে মালদা শহরও ।
এদিন মন্ত্রীর ভাঙন পরিদর্শনের আগে গ্রামের বাসিন্দা আবু বক্কর বলেন, "একসময় এই গ্রাম থেকে গঙ্গা প্রায় 10 কিলোমিটার দূরে ছিল । আমরা গঙ্গা সম্পর্কে জানতাম না । আর এখন সেই গঙ্গা বালুটোলায় এসে ঠেকেছে । এতদিন ধরে গঙ্গার ভাঙন হচ্ছে, কিন্তু সরকার ভাঙন রোধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি । ভাঙনের জন্য এর আগে আমি তিনবার বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি । এখনও যদি গঙ্গাকে বেঁধে দেওয়া যায়, তবে বালুটোলার লোকজন বাঁচবে । আমরা মনে করি, এখানে গঙ্গায় স্পার দেওয়া দরকার । ইতিমধ্যে হাজার হাজার বিঘা জমি নদীতে চলে গিয়েছে । 1994 সালের আগে থেকে নদী পাড় কাটছে । কিন্তু কোনও সরকারই কোনও ব্যবস্থা নেয়নি ।"
গ্রামের আর এক বাসিন্দা মহম্মদ আলাউদ্দিনের বক্তব্য, "চলতি মরশুমে গঙ্গায় মারাত্মক ভাঙন শুরু হয়েছে । মানুষ কান্নাকাটি করছে । আগে গঙ্গা অনেক দূরে ছিল । কয়েক বছরের মধ্যে নদী বালুটোলায় চলে এসেছে । এই মুহূর্তে নদী থেকে বাঁধের দূরত্ব মাত্র 169 মিটার । এই বাঁধ ভেঙে গেলে গোটা মালদা জেলা ভাসবে । এই বাঁধ এবং এলাকার মানুষকে বাঁচাতে গঙ্গার পাড় বাঁধার পাশাপাশি স্পার তৈরি করতে হবে । গঙ্গা জমি কেটে নিলে মানুষকে ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে যেতে হবে । সাধারণত এখানে ভাদ্র মাসে গঙ্গার ভাঙন হয় । এবার আষাঢ় মাসেই ভাঙন শুরু হয়ে গিয়েছে । আরও প্রায় আড়াই মাস ভাঙন চলবে । এবার নদীর গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, এই গ্রামে মানুষ আর থাকতে পারবে না । সবার রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে ।"
মানিকচক পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য মহম্মদ হেনসার আলি বলেন, "এর আগে গঙ্গা বালুটোলা গ্রামকে দু’বার কেটেছিল । এবার তৃতীয় দফায় বালুটোলায় ভাঙন শুরু হয়েছে । 4-5 দিনের মধ্যে প্রায় 200 মিটার এলাকা নদীতে তলিয়ে গিয়েছে । নদী এখন আর শ’দেড়েক মিটার দূরে বাঁধ । বাঁধ কেটে গেলে দুর্দশা আরও বাড়বে । ভাঙনে এই অঞ্চলেরই অন্তত 11 হাজার মানুষ বিপর্যস্ত । মানুষ ভীষণ বিপন্নতায় দিন কাটাচ্ছে । তাদের জন্য আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছি । আমরা মন্ত্রীকে এখানে এসে পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখার আবেদন জানিয়েছিলাম । তিনি আজ আসছেন । তিনি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, সে দিকেই তাকিয়ে সবাই ৷ এটা ঠিক, গঙ্গা ভাঙন রুখতে 1994 সাল থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি । আমরা বারবার সেই দাবি করেছি । কিন্তু কাজ হয়নি । তবে এবার মনে হচ্ছে, সরকার কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।"
আরও পড়ুন : নদী ভাঙনকে "জাতীয় বিপর্যয়" ঘোষণা করা হোক, প্রধানমন্ত্রীকে আর্জি অধীরের
এদিন বালুটোলা গ্রাম পরিদর্শন করে মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, "সেচ দফতরের তরফে আমরা আজ এখানে এসেছি । এই এলাকা আমাদের নজরদারিতেই ছিল । প্রতিদিন এলাকার ভাঙন পরিস্থিতির রিপোর্ট নিচ্ছি । তার ভিত্তিতেই আমরা এখানে তিনটি পয়েন্টে গঙ্গা ভাঙন রোধে আপৎকালীন কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি । তার জন্য প্রায় 65 লাখ টাকা বরাদ্দ হচ্ছে । গতবারও এখানে ভাঙন হয়েছে । আগামী বছরের মধ্যে আমরা এখানে স্থায়ী কাজ করতে চাই । তার জন্য দফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি । কারণ, মা-মাটি-মানুষের সরকার মানুষকে ফেলে দিতে পারে না । প্রয়োজনে বিপন্ন গ্রামবাসীর জন্য আমরা কাছাকাছি কোনও স্কুলে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করব । পরবর্তীতে খাস জমি দেখে আমরা এই মানুষজনকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করব । মানুষ আমার কাছে নিরাপদে থাকার দাবি জানিয়েছেন । আমরা ভাঙন রোধের জন্য সবরকম চেষ্টা করছি । আপাতত ক্রেট ও বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন আটকানোর চেষ্টা করা হবে । আমাদের ভয়, আগস্টে বেশি বৃষ্টি হতে পারে । তখন সমস্যা আরও বাড়বে ৷ আর শুখা মরশুমে কাজ করলেও সেচ দফতরকে বর্ষায় কাজ করতেই হবে । কারণ কারোর জানা নেই, নদী কোন পথে এগোবে । কোথায় ভাঙন হবে । এবার বৈষ্ণবনগরের লালুটোলাতেও গঙ্গার ভাঙন হচ্ছে । সেখানে ভাঙন রোধের দায়িত্ব ফরাক্কা ব্যারেজ প্রোজেক্টের । তারা কোনও কাজ করছে না । আমি কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও দফতরের কর্তাদের নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম । তাদের কাজ শুরু করার আবেদন করেছিলাম । কিন্তু এখনও তারা কাজে হাত দেয়নি । তারা যদি কাজ করতে না চায় তবে আমাদের জানাক । কারণ মানুষগুলো এই রাজ্যের । আমরা তাদের ফেলে দিতে পারি না ।"
মন্ত্রীর আশ্বাসে যেন অনেকটাই শান্তি পেয়েছেন গোপালপুর পঞ্চায়েতের সদস্য মহম্মদ মোস্তাক । তিনি বলেন, "আমাদের এখানে অন্তত 30 হাজার মানুষ বাস করেন । প্রতিটি মানুষ এখন আতঙ্কে রয়েছেন । ঘর হারানোর ভয়ে আমরা ঘুমোতে পারছি না । আমরা এলাকার বিধায়ক সাবিত্রী মিত্রের মাধ্যমে সাবিনাদিকে ডেকেছিলাম । তিনি এখানে এসেছেন । তাঁর কাছে আমরা গঙ্গার পাড় বাঁধাইয়ের দাবি জানিয়েছি । তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, অর্থ হাতে এলেই সেই কাজ করা হবে । আমরা তাঁর কথায় সন্তুষ্ট ।"
আরও পড়ুন : বর্ষা শুরু হতেই গঙ্গার চোখরাঙানি, ভাঙন মালদার দুই ব্লকে