মালদা, 10 অক্টোবর : কোরোনায় ফিকে হয়েছে উৎসবের রং। তার উপর দেশের বিভিন্ন অংশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ধর্মীয় ভেদাভেদ। কোথাও আবার উচ্চবর্ণের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে দলিত সম্প্রদায়। এসবের মধ্যেই ব্যতিক্রমী মালদা শহরের উত্তর পিরোজপুর। প্রায় 15 বছর আগে এখানকার হরিজন সম্প্রদায়ের আর্জিতে এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় মুসলিম যুবকরা। তাঁদের উদ্যোগে এবং এলাকার হিন্দুদের সহায়তায় পত্তন হয়েছিল একটি দুর্গাপুজো। তখন থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই পুজো হয়ে আসছে। বয়সে নবীন। কিন্তু ধর্মীয় ভেদাভেদ সরিয়ে রেখে এই পুজোয় জড়িয়ে রয়েছে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস।
ইংরেজবাজার পৌরসভার 6 নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে মালদা শহরের সবচেয়ে বড় হরিজন বস্তি। অন্তত 200 পরিবারের বসবাস। শুধু হরিজন নয়, ওই পাড়ায় হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেক পরিবারও বসবাস করে। হরিজনরা হিন্দু হলেও দলিত বলে তাদের দূরে সরিয়ে রাখে সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত অংশ। ফলে এখনও শিক্ষার আলো থেকে তাদের বেশিরভাগই অনেক দূরে। তাদের জীবনশৈলি প্রভাব ফেলেছে স্বাস্থ্যে। অথচ এই হরিজনরাও হিন্দু দেবদেবীর পূজারি। যদিও বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাতেও তাদের কোন মন্দিরে উঠতে দেওয়া হয় বলে খবর মেলেনি। ফলে নিজেদের ধর্মাচরণের জন্য বাড়িই ভরসা তাদের। তা বলে বাড়িতে দুর্গাপুজো! সেটা এই মানুষদের কল্পনাতেও আসে না। অথচ তারাও চান দুর্গার পুজো করতে, পুষ্পাঞ্জলি দিতে, সবার মতো পুজোয় আনন্দ করতে। সেটা কীভাবে সম্ভব! বছর পনেরো আগে এলাকারই কয়েকজনকে নিজেদের খেদের কথা জানিয়েছিল হরিজনরা। কোনও হিন্দু নয়, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল এলাকার কিছু মুসলমান যুবক। তাদের উদ্যোগেই 14 বছর আগে এখানে একটি দুর্গাপুজো শুরু করা হয়। নাম দেওয়া হয় 'মালদার ঐক্য'। নামেই বোঝা যায়, এই পুজো বিশেষ কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নয়। এই পুজো মানুষের।
শুরুর দিন থেকে এই পুজো কমিটির সম্পাদক স্থানীয় ববি আহমেদ। অবশ্য শুধু দুর্গাপুজো নয়, তিনি এলাকার মসজিদ কমিটি, শনিপুজোর মন্দির থেকে শুরু করে মুসলিম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। 50 বছর বয়সেও তারুণ্যে ভরপুর। তিনি বলেন, "13-14 বছর আগে পাড়ার হরিজন ভাইয়েরা আমাকে এসে বলে, দুর্গাপুজোয় তাদের কেউ অংশ নিতে দেয় না। তাদের অঞ্জলি দিতে দেয় না। এমনকি মণ্ডপের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেয় না। ওরা আবদার করে, ওদের জন্য দুর্গাপুজো শুরু করতে হবে। এদিকে আমি হিন্দু ধর্মের আচার, বিধি কিছুই জানি না। অনেক চিন্তাভাবনা করে আমি এলাকার হিন্দুদের সঙ্গে আলোচনায় বসি। সবাই মিলে ঠিক করি, এলাকায় হিন্দু, মুসলমান ও দলিতরা একসঙ্গে দুর্গাপুজো করব। তখন থেকেই ধারাবাহিকভাবে এই পুজো হয়ে আসছে। এই পুজোয় সব সম্প্রদায়ের মানুষ অংশ নেয়। হিন্দু ও দলিতদের সঙ্গে মুসলমানরাও মণ্ডপ তৈরি, সাজানো, প্রতিমা নিয়ে আসা, দল বেঁধে বিসর্জনে অংশ নেয়। মুসলমানরা অঞ্জলি না দিলেও পুজোর আনন্দ উপভোগ করে। আমাদের এই শহরে কোনওদিনই সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ নেই। এখানে প্রতিটি উৎসবে সব সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে আনন্দ করে।" তাঁর কথায় জানা যায়, ইদে হিন্দুরাও মুসলিম যুবকদের সঙ্গে বসে একসঙ্গে খাবার খায়, পুজোতেও তেমনি মুসলিমরাও হিন্দুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যায়। এখন গোটা দেশেই সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি মহালয়ায় দুর্গা চরিত্রে অভিনয় করায় সাংসদ নুসরত জাহানকে মৌলবাদীদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু এখানে সেসব কিছু নেই। উলটে এখানকার মৌলনারা মুসলিমদের সবাইকে একসঙ্গে থাকার পরামর্শ দেন, উৎসাহ জোগান। ববি আহমেদ বলেন," আমি নিজে দুর্গাপুজো কমিটির সম্পাদক, মসজিদ কমিটির সহ সর্দার, শনি মন্দিরের সভাপতি, মুসলিম ইনস্টিটিউটের সম্পাদক। আমি সবাইকে বলতে চাই, দু'দিনের জীবন। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে কেউ কিছু নিয়ে যেতে পারব না। তাই সবাইকে মিলেমিশে থাকতে হবে। আমরা সবাই মানুষ।"
পুজো কমিটির অন্যতম সদস্য দেবাশিস চন্দ বলেন, "পৃথিবীতে দুটো জাত। নারী ও পুরুষ। এর বাইরে আর কিছু নেই। আমরা হিন্দু, মুসলমান, দলিত, সবাই মিলে এই পুজো করি। এখানে এসে কেউ বুঝতে পারবে না, আমরা কে কোন সম্প্রদায়ের। কিছু দুষ্ট লোক নিজেদের স্বার্থে দেশে ধর্মীয় ভেদাভেদ তৈরি করতে চাইছে। আমরা আগে মানুষ, তারপর আমাদের ধর্ম। উৎসব মানুষের। তাই আমরা সবাই একসঙ্গে এই পুজো করি। আমরা মানুষকে সেই বার্তাটাই দিতে চাই। মালদার মানুষ যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়ায়, সেকথা বলে শেষ করা যায় না।" এলাকার হরিজন সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধি শিবা হরিজন বলেন, "আগে আমরা দুর্গাপুজো করতে পারতাম না। এলাকার মুসলিম ও হিন্দু ভাইদের জন্য এখন আমরা মায়ের পুজো করতে পারি। খুব ভালো লাগে। সবাই একসঙ্গে আনন্দ করি। আমরা চাই, এমন পুজো আরও হোক। তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কমে যাবে। সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার রসদ পাবে।"