মালদা, 12 ডিসেম্বর : এখনও ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কোতয়ালির শাহ জালালপুর গ্রামের বাসিন্দারা ৷ গ্রামের এক দুধ ব্যবসায়ী যে খুন করে সেই প্রমাণ লোপাটের জন্য দেহ পুড়িয়ে দিতে পারে, তা তাদের ধারণার বাইরে ৷ এই ঘটনায় দোষী বাপন ঘোষের ওরফে ছোটনের কঠোর শাস্তি দাবি করছে তারা ৷ একই দাবি করেছেন বাপন ঘোষের মামাও ৷ মামার বাড়িতেই ছেলেবেলা কাটিয়েছিল বাপন ৷ গোটা ঘটনার প্রেক্ষিতে এখনও শাহ জালালপুর গ্রামে আতঙ্কের পরিবেশ ৷ নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ক্যাম্প বসানোর দাবি উঠেছে গ্রামে ৷
পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, এই ঘটনায় ছোটনের সঙ্গে আরও একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকার সম্ভাবনা ক্রমশই প্রবল হচ্ছে ৷ সেই সম্ভাবনা থেকেই ছোটনের স্ত্রী সহ মোট 4 জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে ৷ তবে এই বিষয়ে আজ কোনও পুলিশ কর্তা সংবাদমাধ্যমকে কিছু জানাতে চাননি ।
গত 5 ডিসেম্বর শাহ জালালপুর গ্রাম থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই ধানতলা গ্রামের এক আমবাগান থেকে এক তরুণীর দগ্ধ দেহ উদ্ধার করে পুলিশ ৷ তদন্তের শুরুর পর গতকালই সেই যুবতির পরিচয় জানা গেছে ৷ বছর পঁচিশের ওই যুবতি শিলিগুড়ির অম্বিকানগর এলাকার বাসিন্দা ৷ তাঁর সঙ্গে ছোটনের সম্পর্ক ছিল ৷ সেই সম্পর্কের টানে তিনি মাঝেমধ্যেই মালদায় আসতেন ৷ দু’একদিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন ৷ কিন্তু এবার 2 ডিসেম্বর NJP থেকে মালদায় আসার পর তিনি আর বাড়ি ফেরেননি ৷ তাঁর পরিবারের লোকজনও জানতে পারেনি, ঝুমা দে নামে ওই যুবতিকে মালদার এক আমবাগানে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে ৷ শেষ পর্যন্ত গতকালই সব কিছু জানা যায় ৷ গ্রেপ্তার করা হয় ছোটনকে ৷ তার স্ত্রী টুম্পা ঘোষকেও আটক করেছে পুলিশ ৷
আরও পড়ুন : পরকীয়ার জেরেই মালদায় যুবতিকে খুন, জানাল পুলিশ
আজ ধৃত ছোটনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় সেখানে কেউ নেই ৷ বাড়ির গোয়ালে একটি গোরু, বাছুর ও দুটি ছাগল ৷ আজও সেই বাড়ির সামনে পড়শিদের ভিড় ৷ এখনও কেউ ভাবতে পারছেন না, ছোটন এভাবে একটি মেয়েকে মালদায় ডেকে এনে নৃশংসভাবে খুন করেছে ৷ আরও বড়ো বিষয়, গ্রামের অনেকেই জানিয়েছে, যেদিন ঝুমার মৃতদেহ আমবাগানে পড়ে থাকতে দেখা যায়, সেদিন পুলিশের উপস্থিতিতেই ছোটনকে সেখানে দেখা গিয়েছিল ৷ গ্রামবাসীদের অনেকেই ঘটনাস্থানে সেদিন ছোটনকে দেখেছে ৷ যদিও পুলিশের ভয়ে ক্যামেরার সামনে সেকথা কেউ জানাতে রাজি হয়নি ৷ ছোটনের বাড়ির সামনেই থাকেন বিশ্বনাথ দাস ৷ তিনি বলেন, "বছর দুয়েক ধরে ছোটন এখানে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে ৷ সারাক্ষণই তার কানে ফোন থাকত ৷ এই নিয়ে আমি ওকে প্রশ্নও করেছিলাম ৷ কোনও উত্তর দেয়নি ৷ ওর বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদেরও দেখা যায়নি ৷ বুঝতেই পারিনি এমন ঘটনা ও ঘটাতে পারে ৷ ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও তেমন কোনও ঝামেলা ছিল না ৷ তবে ওদের সঙ্গে আমরা কেউ তেমনভাবে মিশতাম না ৷ ছোটন মালদা শহরেই দুধের ব্যবসা করত ৷ সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকত ৷"
গ্রামের আরেক বাসিন্দা হাসি দাস বলেন, " এমন ঘটনার কথা ভাবতেও পারিনি ৷ ভয়ে ছেলেমেয়েরা এখন বাড়ি থেকে বেরোতে চাইছে না ৷ স্কুল কিংবা টিউশনেও কেউ যাচ্ছে না ৷ পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে ৷ আমরা চাই, এখানে পুলিশি নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হোক ৷ এখানে একটা পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও পুলিশ থাকে না ৷ সেখানে পুলিশ নিয়োগ করা হোক ৷ তবে একটা কথা ঠিক, আর আমরা ছোটনদের এখানে থাকতে দেব না ৷ আমাদের ঘরে ছেলেমেয়ে রয়েছে ৷ ওরা যে ফের এমন ঘটনা ঘটাবে না সেটা কে বলতে পারে? তাই এখান থেকে ওদের উঠে যেতে হবে ৷"
ছেলেবেলায় ছোটন মামার বাড়িতে মানুষ ৷ তার মামা শ্রীদাম ঘোষের বাড়ি কোতয়ালিরই টিপাজানি গ্রামে ৷ আজ ছোটনের পালিত গোরুকে খাবার দিতে এসেছিলেন তিনি ৷ তিনি বলেন, "ছোটবেলায় দুই ভাগ্নে আমাদের বাড়িতে থাকত ৷ একটু বড়ো হলে ওদের নিয়ে চলে যায় বাবা-মা ৷ ছোটন দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনাও করেছে ৷ পড়াশোনা শেষ করে ওরা ফের এখানে চলে আসে ৷ তবে এই ঘটনায় ছোটন দোষী প্রমাণিত হলে আমিও ভাগনের কঠোর শাস্তি চাই৷"
আরও পড়ুন : প্রেমিকের থেকে মোবাইল আনতেই মালদায় গিয়েছিল ঝুমা, বলছে বান্ধবী
ছোটনের বাড়ির পিছনদিকে 200 মিটারের মধ্যে জেলার কংগ্রেস নেতা প্রয়াত বরকত গণি খান চৌধুরি বাড়ি ৷ সেই বাড়িতেই থাকেন দক্ষিণ মালদার সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরি ও জেলা তৃণমূল সভানেত্রী মৌসম নুর ৷ আজ তাঁদের কাউকে অবশ্য বাড়িতে পাওয়া যায়নি ৷ তবে ছোটনের বাড়ি থেকে আমবাগানের ভিতর দিয়ে ঘটনাস্থানের দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয় ৷ আজ ছোটনকে 14 দিনের পুলিশি হেপাজতের আবেদন জানিয়ে জেলা আদালতে তোলা হয় । ছোটনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির 302 ধারায় খুন, 201 ধারায় প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা ও 34 নম্বর ধারায় সংগঠিতভাবে অপরাধ করার মামলা রুজু করেছে পুলিশ ৷ 34 নম্বর ধারা প্রয়োগ করে পুলিশ কার্যত জানান দিচ্ছে, এই ঘটনায় ছোটন ছাড়াও আরও একাধিক ব্যক্তি জড়িত রয়েছে ৷ এখন দেখার, এই ঘটনায় জড়িত আর ক’জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ৷