মালদা, 16 মে : দেশে কোরোনা সংক্রমণ রুখতে জারি করা হয়েছে লকডাউন ৷ সংক্রমণ তেমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলেও মাথায় হাত পড়েছে হোটেল-রেস্তরাঁ ব্যবসায়ীদের ৷ গত 24 মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সমস্ত হোটেল-রেস্তরাঁ ৷ বন্ধ রাস্তার ধারের ছোটো-খাটো খাবারের দোকানও ৷ লকডাউন কবে উঠবে, তা জানা নেই ৷ লকডাউন উঠলেও তাঁরা আদৌই লাভের মুখ দেখবেন কিনা তা নিয়ে চিন্তায় হোটেল ব্যবসায়ীরা ৷ কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোরোনা সংক্রমণ রুখতে আপাতত এক বছর সম্পূর্ণভাবে এড়াতে হবে হোটেল-রেস্তরাঁ ৷
মালদা জেলায় হোটেল ব্যবসা মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় মালদা হোটেল অ্যান্ড রেস্তরাঁ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের দ্বারা৷ এই সংগঠনের আওতায় রয়েছে 67টি ছোট-বড় হোটেল-রেস্তরাঁ ৷ এর বাইরে আরও 6টি বড় হোটেল রয়েছে জেলায়৷ রয়েছে অন্তত 50টি ছোট রেস্তোরা ৷ এছাড়াও জাতীয় সড়কের ধারে রয়েছে প্রায় শ’খানেক ধাবা ও প্রায় 300 অস্থায়ী খাবারের দোকান৷ সব মিলিয়ে এই শিল্পের উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল বেশ কয়েক হাজার মানুষ ৷ পরোক্ষভাবে এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে মাছ-মাংস বিক্রেতা ৷ হোটেল-রেস্তরাঁর উপর নির্ভর করে অন্য পরিষেবায় যুক্ত থাকা বহু মানুষও ৷
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কর্মচারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন হোটেল-রেস্তরাঁ মালিকরা ৷ ব্যবসা বন্ধ থাকলেও মাস শেষে মিলছে বেতন ৷ কিন্তু এভাবে আর ক’দিন ? মালিকদের ভাঁড়ারেও টান পড়ছে এবার ৷ মালদা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কৃষ্ণেন্দু চৌধুরি বলেন, “ কোরোনা ভাইরাসের ফলে আমরা প্রথম থেকেই সংকটে৷ কবে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব জানি না৷ দেশে কোরোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরেই আমাদের ব্যবসা কমতে শুরু করে৷ লকডাউনে তা শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে৷ আমাদের সংগঠনে থাকা মালদা শহরের 67টি বড় হোটেলে কর্মীর সংখ্যা 700 জনের বেশি৷ এই কর্মীরা সবাই বাড়িতে বসে রয়েছে৷ মালিকদের অবস্থা আরও শোচনীয়৷ এই পরিস্থিতিতেও তাঁরা কর্মীদের বেতন দিচ্ছেন৷ কারণ, এই শ্রমিকদেরও সংসার রয়েছে৷ টাকা তাদেরও প্রয়োজন৷’’
তিনি আরও বলেন,‘‘হোটেল শিল্পের সঙ্গে বেশ কিছু অন্যান্য শিল্পও ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে ৷ বর্তমানে বাইরে থেকে কাজ করতে আসা লোকজন থাকার জায়গা পাচ্ছে না৷ খাবারও পাচ্ছে না তারা ৷ ভিনরাজ্য থেকে আসা লরিচালকরাও খাবার কিংবা আশ্রয় পাচ্ছে না কারণ জাতীয় সড়কের ধারে ধাবাগুলি বন্ধ৷ জেলায় অস্থায়ী খাবারের দোকানও 300-এর উপর৷ সেখানেও হাজার খানেক কর্মীরা কাজ করে৷ এককথায় বলতে গেলে কোরোনার ফলে হোটেল শিল্প পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে৷ শুধুমাত্র বড় হোটেলগুলিতেই বছরে প্রায় 80 কোটি টাকার ব্যবসা হয়৷ মূলত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত হোটেল ব্যবসা সবচেয়ে ভালো হয়৷ কিন্তু এখন সবই বন্ধ৷ কিছু ছোট হোটেল এপ্রিল মাসের অর্ধেক বেতন কর্মীদের দিয়েছে৷ যদিও তারা কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছে, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই কর্মীদের বকেয়া 50 শতাংশ বেতনও দিয়ে দেওয়া হবে৷ কারোর কোনও বেতন কাটা হবে না৷ কারণ, আমরা সরকারের নির্দেশ মেনেই হোটেল বন্ধ রেখেছি৷ কর্মীরা তো নিজে থেকে কাজ বন্ধ করেনি! কিন্তু কতদিন আমরা চালাতে পারব জানি না৷ এখন আমাদের ঘরেও আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে৷ ঘরের পুঁজিই ব্যবসায় ব্যবহার করতে হচ্ছে৷ কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে জানা নেই৷ এই পরিস্থিতিতে আমরা সরকারের কাছে বিভিন্ন কর মুকুবের দাবি জানাচ্ছি৷”
পেশায় হোটেল ম্যানেজার শুভঙ্করকুমার ঝা প্রায় একই সুরে বলেন, “লকডাউনে আমাদের অবস্থা খুবই সঙ্গীন৷ ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ৷ মালিকরা এখনও বেতন দিয়ে যাচ্ছেন৷ কিন্তু কতদিন বেতন পাব জানি না৷ বাড়ির সবাই আমার উপর নির্ভরশীল৷ কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে জানি না৷ এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সবাইকে না খেয়েই মরতে হবে৷ মালিকরাও বা কতদিন আমাদের বসিয়ে বেতন দেবেন? সরকারের তরফ থেকে এখনও কোনও সাহায্য পাইনি৷ আমরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের আর্জি জানাচ্ছি৷ ”
ঝাঁপ বন্ধ হোটেলের সামনেই বসেছিলেন কর্মী কুরবান মহালদার৷ তিনি বলেন, “পরিস্থিতি খুবই খারাপ৷ লকডাউন শুরু হতেই ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ কোনও রকমে সংসার চালাচ্ছি৷ এখনও মালিক পাশে রয়েছেন৷ কিন্তু তিনিই বা কতদিন এভাবে আমাদের চালাবেন? লকডাউন উঠে গেলেও হোটেল খোলার কোনও সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না৷ ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না ৷’’
লকডাউনের আঁধারের মাঝেও আশার আলো খুঁজছেন কেউ কেউ৷ এক হোটেল কর্মী সঞ্জীব দাস বলেন, “হোটেল ব্যবসার পরিস্থিতি খুব খারাপ৷ দু’মাস ধরে সব বন্ধ৷ ব্যবসায় কোরোনার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়বে৷ কবে সব স্বাভাবিক হবে বলা যাচ্ছে না৷ তবে জীবন থেমে থাকে না৷ এই দুঃসময়ও একদিন শেষ হবেই৷ আমিও সেই আশায় দিন গুনছি ৷”