মালদা, 20 ডিসেম্বর : গ্রন্থাগার ৷ অজস্র মানুষের শব্দহীন মিলনের মুক্তমঞ্চ, যেখানে উত্তর রয়েছে হাজারো বছর ধরে জমে থাকা সমস্ত প্রশ্নের ৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে ৷ মানব আত্মা অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে ৷” প্রতিটি মানুষ ছোট থেকে শুনে ও জেনে এসেছে, গ্রন্থাগার শিক্ষার আকর ৷ কিন্তু, সেই শিক্ষার শিকড়টাই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে মালদা জেলায় (Habit of Reading Books in Library is Decreasing Among Readers) ৷
শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই ৷ এই জেলায় সরকারি গ্রন্থাগারের সংখ্যা 105টি ৷ তবে, এর মধ্যে পঞ্চানন্দপুরের একটি গ্রামীণ গ্রন্থাগার গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে ৷ সেই গ্রন্থাগারের যাবতীয় বইপত্র এখন সেখানকার অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিকের ঘরে বস্তাবন্দি ৷ এখন 104টি সরকারি গ্রন্থাগার জেলায় চালু রয়েছে । একইসঙ্গে চালু রয়েছে বিভিন্ন ক্লাব বা ট্রাস্ট পরিচালিত আরও কিছু গ্রন্থাগার ৷
কিন্তু, বিজ্ঞান যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন মানুষের কাছে ব্রাত্য হয়ে পড়ছে গ্রন্থাগারগুলি ৷ এক দশক আগেও প্রতিটি গ্রন্থাগারে সকাল-সন্ধে অনেক পাঠক যেতেন । বই থেকে খুঁটে বের করতেন তাদের না জানা অনেক প্রশ্নের উত্তর । অনেক অজানাকে জেনে ঘরে ফিরতেন । কিন্তু এখন সেই দৃশ্য আর কার্যত দেখা যায় না (In Digital Age Habit of Reading Books Decrease Among Readers) । নির্দিষ্ট সময় গ্রন্থাগার খোলে বটে ৷ কিন্তু, সারা দিনে হাতেগোনা কয়েকজন পাঠককেই সেখানে দেখা যায় ৷ করোনার জেরে পরিস্থিতিটা আরও খারাপ ৷ অদ্ভুত বিষয়, গ্রন্থাগারের আধুনিকীকরণ কিংবা পাঠককে গ্রন্থাগারমুখী করতে সরকারের কোনও পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না (Empty Libraries in Malda) ৷ নইলে এই জেলায় চালু থাকা 104টি গ্রন্থাগারের জন্য মাত্র 33 জন গ্রন্থাগারিক থাকেন কীভাবে ?
1937 সালে স্থাপিত হয়েছিল মালদা জেলা গ্রন্থাগার ৷ 1957 সালে সরকার সেটিকে নিজেদের হাতে নেয়। মালদা শহরের বাঁধ রোডে বিশাল এলাকা জুড়ে এই গ্রন্থাগার। এখানেও কোনও গ্রন্থাগারিক নেই। গত বছর থেকে একজনকে গ্রন্থাগার চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি তুষারকান্তি মণ্ডল ৷ পরিস্থিতি যে ভালো নয়, তা স্বীকার করেছেন তিনিও। তুষারকান্তি মণ্ডল বলেন, “গ্রন্থাগারিক না থাকলে গ্রন্থাগারের উপর তার প্রভাব পড়বেই ৷ কারণ, গ্রন্থাগারিকই গ্রন্থাগারের যাবতীয় কাজ করে থাকেন। এর প্রভাব পাঠকদের উপরেও পড়ে ৷ গ্রন্থাগারিক না থাকায় কোনও গ্রন্থাগারই প্রতিদিন খোলা যায় না । আমি যতদূর জানি, প্রতি মাসেই রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে গ্রন্থাগারে শূন্য পদের হিসাব পাঠানো হয় ৷ জানতে পেরেছি, গোটা রাজ্যে 729 জন গ্রন্থাগারিক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে ৷ এর মধ্যে মালদা জেলার জন্য 28টি পদ বরাদ্দ রয়েছে ৷ এই গ্রন্থাগারে খাতায় কলমে লক্ষাধিক বই রয়েছে ৷ কিন্তু, লকডাউনের সময় আমরা বইয়ের হিসাব করেছিলাম ৷ সেই সময় এখানে প্রায় 60 হাজার বই আমরা পেয়েছি ৷ পাঠকদের হাতে রয়েছে আরও হাজার কুড়ি বই। বাকি কিছু বই নষ্ট হয়েছে। এখানে 41টি প্রাচীন পুঁথিও রয়েছে। কিন্তু, এখন সেভাবে পাঠক পাচ্ছি না ৷’’
আরও পড়ুন : 50 Years of Bangladesh Liberation War: স্মরণে 1971, পড়ুয়াদের যুদ্ধের পাঠ শেখালেন জওয়ানরা
তাঁর মতে, কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো তো বটেই, সরকারি গ্রন্থাগারগুলিকে কম্পিউটারাইজড হতে হবে ৷ বইয়ের তালিকা ও তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিতে পারলে, পাঠকরা বাড়িতেই নিজেদের প্রয়োজনীয় বই খুঁজে নিয়ে গ্রন্থাগারে গিয়ে পড়তে পারবেন ৷ তুষারকান্তি মণ্ডল মনে করেন, এখন প্রত্যেকের কাছেই সময় খুব মূল্যবান ৷ তাই সেই চেষ্টা শুরু হয়েছে। আশা করা হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই রাজ্যের সব গ্রন্থাগারগুলিকে কম্পিউটারাইজড করার কাজ শেষ হয়ে যাবে ৷ এর সঙ্গে গ্রন্থাগারে আন্তর্জাতিক মানের পত্রপত্রিকা আরও রাখা প্রয়োজন বলে জানান তিনি ৷ তবে, নতুন প্রজন্ম এখন গ্রন্থাগারে আসছেন পড়াশোনা করতে ৷
আরও পড়ুন : Durga Idol with Match Box: দেশলাই কাঠির দুর্গা প্রতিমা বানিয়ে রেকর্ড লাইব্রেরিয়ানের
মালদা শহরের কেন্দ্রস্থলে মুসলিম ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরিটি আরও পুরনো ৷ 1929 সালে তৈরি হয়েছিল এই লাইব্রেরি ৷ সেখানকার ছবিটাও এক ৷ পাঠকের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। ইন্সটিটিউটের সম্পাদক ববি আহমেদ জানালেন, “কিছুদিন আগেও প্রতিদিন অন্তত 50-60 জন পাঠক আসতেন ৷ কিন্তু, করোনা শুরু হওয়ার পর লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যায় ৷ সরকারি বিধিনিষেধ কাটিয়ে এখন লাইব্রেরি খোলা হলেও দিনে দুই থেকে তিনজনের বেশি পাঠককে দেখা যাচ্ছে না। মানুষ লাইব্রেরি আসার অভ্যেসটাই যেন হারিয়ে ফেলেছে। আমার ধারণা, তাঁদের পুরনো অভ্যেসে ফিরে আসতে অন্তত বছর দেড়েক সময় লাগবে। এখানে প্রতিদিন 14-15টি সংবাদপত্র আসছে। অনেক পত্রিকা আসছে। এখানে অনেক ভাষা এবং অনেক বিষয়ের বই রয়েছে। শুধু পাঠকেরই অভাব। আমাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। mmi.com-এ সার্চ করলেই এখানে থাকা বইপত্রের সমস্ত তথ্য পাঠকরা জানতে পারবেন। পাঠকদের জন্য আমরা সন্ধেয় চায়ের ব্যবস্থাও করেছি । তবু কাজ হচ্ছে না ।”
বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন জেলার অন্যতম শিক্ষাবিদ, বঙ্গরত্ন শক্তিপদ পাত্র। তিনি বলেন, “উনবিংশ শতকেও গ্রন্থাগারের ভূমিকা নিয়ে তৎকালীন সাহিত্যিকরা লিখে গিয়েছেন। অনেকে বলবেন, এখন বাড়িতে বসেই ইন্টারনেটে গ্রন্থাগার পাওয়া যায়। কিন্তু, সাধারণ মানুষ এর ব্যবহার করে না। বেশিরভাগ মানুষ হার্ড কপিতেই অভ্যস্ত। কিন্তু বই থেকেই সব শেখা উচিত। শিক্ষক হলেন একজন সূত্রধর। বইয়ের সঙ্গে পাঠকের মেলবন্ধন করবেন। গ্রন্থাগার যেমন তথ্য সরবরাহ করে, তেমনই মানুষের জীবনকে সুন্দর করে। বইয়ের মাধ্যমে মানুষ অনেক বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে আসে। পাঠক পেতে গেলে লাইব্রেরিগুলিকে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বই কিনতে হবে। লাইব্রেরিকে শিশুদের কাছে আকর্ষণের মাধ্যম হিসাবে তুলে ধরতে হবে। গ্রামীণ এলাকার মানুষকে পড়ার অভ্যেস করাতে হবে। তার জন্য গ্রামীণ গ্রন্থাগারিকদের উচিত, লাইব্রেরিকে কমিউনিটি সেন্টার হিসাবে গড়ে তোলা ৷’’
প্রখ্যাত সাহিত্যিক তৃপ্তি সান্ত্রা বলেন, “নতুন যুগে ঢোকার আগে আমরা দু’হাত তুলে নেত্য করেছি, মুঠ্ঠিমে দুনিয়া চলে এল বলে। সেসব চলে আসার পর পুরনো জায়গায় ফিরে যাওয়াটা একটা অসম্ভব কাজ। আমাদের হাতে যে যন্ত্র চলে এসেছে, তাতে বলা যায়, লাইব্রেরি আমাদের বুক পকেটে রয়েছে। কিন্তু, দৃশ্যমাধ্যমের কুফল যে কতটা বেশি, তা আমরা বুঝতে পেরেছি। আগে আমরা ফাস্ট ফুড জানতাম না। এখন সবসময় ইনস্ট্যান্ট ফুড। এতে বাচ্চা ও তাদের বাবা-মায়েরাও এখন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু, এর ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। একই অবস্থা বই পড়ার ক্ষেত্রেও। দেখা আর পড়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। দৃশ্যতে কোনও কল্পনা থাকে না। বই পড়ে একজন পাঠকের কল্পনাশক্তি বাড়ে। এটা খুব প্রয়োজন। জান্তব বাস্তবতা থেকে পালাতেও এটা কাজে লাগে ৷’’