মালদা, 18 মে : শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস ৷ এগিয়ে আসছে ইদ ৷ তবে বাকি বছরের তুলনায় এবারের চিত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা ৷ লকডাউনের জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সবকিছুই৷ নিম্ন ও মধ্য-নিম্নবিত্ত মানুষ পেটের জ্বালায় মরছে ৷ যান চলাচল বন্ধ থাকায় রেশন কার্ডের সন্ধানে চড়া রোদে 20 কিলোমিটার হেঁটে আসতে হচ্ছে শহরে৷ ত্রাণের চাল-আলু পেতে প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও এলাকায় মানুষ ভিড় করছে ৷ ফলে ধর্ম মেনে রোজার উপোস করলেও এখন মানুষের মধ্যে ইদের উৎসবের রেশ নেই৷ তাই এবার কাপড় ব্যবসায়ীদের মুখেও হাসি নেই ৷
মালদা জেলার 15টি ব্লকে মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত মানুষ রয়েছে প্রায় 58 শতাংশ ৷ তবে ইদের বাজারে কাপড় ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছে ৷ মূলত ইদ ও দুর্গাপুজোতেই ব্যবসা সবথেকে বেশি হয় ৷ কিন্তু কোরোনা ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে ব্যবসায়ীদের মুখের হাসি৷ জেলার কোথাও এখনও পর্যন্ত একটিও কাপড়ের দোকান খুলতে পারেননি ব্যবসায়ীরা ৷ ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ‘‘দোকান খুলেও কোনও লাভ নেই ৷ কারণ, এখন বেঁচে থাকাই প্রধান চিন্তা ৷ সেখানে নতুন জামাকাপড় কেনা তো বিলাসিতা !’’
ইদের বাজারে কাপড়ের ব্যবসা যে ডুবতে বসেছে, তা নিয়ে কারোর কোনও দ্বিমত নেই ৷ ক্ষতির পরিমাণ কতটা? শুনলে চমকে উঠবেন ৷ ক্ষতির অঙ্ক প্রায় 800 কোটি টাকা ৷ মালদা মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের সম্পাদক জয়ন্ত কুণ্ডু বলেন, “শুধু রমজান মাস নয়, চৈত্র মাস থেকেই এই জেলায় কাপড়ের বড় ব্যবসা হয়৷ লকডাউনে এবার চৈত্র মাসের ব্যবসা মার খেয়েছে৷ এখন পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে৷ কিন্তু লকডাউন এখনও জারি রয়েছে৷ এতে এই জেলায় প্রায় 800 কোটি টাকার কাপড়ের ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়েছে ৷ আমরা জেলা প্রশাসন ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন রাখছি, রমজান মাসের কথা মাথায় রেখে যেন কাপড়ের ব্যবসায়ীদের দোকান খুলে দেওয়া হয়৷ ইদ মরশুমে কাপড়ের ব্যবসা চালু করার অনুমতি দিলে ব্যবসায়ীরা কিছুটা ক্ষতি হয়তো সামলে উঠতে পারবেন৷ তা না হলে গোটা জেলার কাপড় ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুব খারাপ হবে৷”
মালদা জেলার কাপড় ব্যবসা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে কালিয়াচক ৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানকার কাপড় ব্যবসায়ীদের মাথাতেও হাত পড়েছে৷ কালিয়াচক মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের সম্পাদক হাজি মহম্মদ নাজিমুদ্দিন বলেন, “কালিয়াচকের তিনটি ব্লকে দুই হাজারের বেশি ছোট-বড় কাপড় ব্যবসায়ী রয়েছেন৷ লকডাউনে সবার ব্যবসা শেষ হয়ে গিয়েছে৷ যারা মহাজনের কাছ থেকে ধার করেছেন, তাঁরা টাকা শোধ করতে পারছেন না৷ মাঝারি ব্যবসায়ীরাও বড় ব্যবসায়ীদের টাকা মেটাতে পারছেন না৷ এখানে কুরবানির বাজার তেমন হয় না৷ ইদেরই বাজারেই যা নতুন জামাকাপড় বিক্রি হয়৷ তবে লকডাউনে মানুষের কাছে খাবার কেনারই টাকা নেই৷ কাপড় কিনবে কোথা থেকে?’’
তিনি আরও যোগ করে বলেন, ‘‘ব্যবসার জন্য আমরা রাজ্য সরকারকে রয়্যালটি দিচ্ছি৷ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কাপড় ব্যবসায়ীদের জন্য কী করছেন? অন্যান্য বছর ইদে কালিয়াচক এলাকাতেই 200 কোটি টাকার কাপড়ের ব্যবসা হয়৷ এবার পুরো ব্যবসাই বন্ধ৷ লকডাউন আরও চললে মাঝারি ও ছোট কাপড় ব্যবসায়ী না খেতে পেয়ে মারা যাবে৷”
কালিয়াচকের এক পাইকারি বস্ত্র ব্যবসায়ী মহম্মদ শাহনাওয়াজ বলেন, “কোরোনা ভাইরাস ও লকডাউনে আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ গত 23 মার্চ থেকে এখনও পর্যন্ত আমাদের ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ৷ কাপড়ের ব্যবসার ক্ষেত্রে কালিয়াচক মূলত পাইকারি মার্কেট৷ কিছু খুচরো ব্যবসায়ীও রয়েছে ৷ এই ব্যবসার পুরোটাই ইদের উপর নির্ভরশীল৷ ডিসেম্বরের শেষ থেকে এই বাজার ধরার কাজ আমরা শুরু করে দিই৷ এবারও সেটাই করেছিলাম৷ কারণ, এখানে দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মাল আসে৷ নির্দিষ্ট সময়ে সেই মাল দোকানে পৌঁছে দিতে হয়৷ কিন্তু তার মধ্যেই কোরোনা মোকাবিলায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়৷ এখনও সেটা চলছে৷ এতে আমরা প্রবল সমস্যায় পড়ে গিয়েছি৷ আমাদের বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরই বেশ কিছু কর্মী রয়েছে৷ আমরা মার্চ মাসের বেতন তাদের দিয়েছি৷ কিন্তু এপ্রিল মাসের বেতন তাদের কীভাবে দেব?’’
তিনি বলেন, ‘‘কর্মীদের বসিয়ে রেখে দু’মাসের বেতন দেওয়া আমাদের পক্ষে কোনওভাবেই সম্ভব নয়৷ আমাদের কাছেও মহাজনরা জিনিসপত্রের টাকা চাইবে৷ আমাদের কাছ থেকে যারা জামাকাপড় নিয়ে গিয়েছে, তাদের কাছেও আমরা এখন টাকা চাইতে পারব না৷ আমাদের ব্যবসা এখন পুরোপুরি স্তব্ধ৷ পরে কী হবে সেটাও জানি না৷ পুজোতেও এবার ব্যবসা হবে কিনা বুঝতে পারছি না৷ সরকারিভাবে যদি আমাদের কথা ভাবা হত, দোকান খোলার অনুমতি দেওয়া হত, তবে হয়তো কিছুটা মাথা তুলতে পারতাম৷ দোকান খুলতে না পারলে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই কাজ হারাবে৷”
মালদা শহরের ছোট কাপড় ব্যবসায়ী বিমল বসাক বলেন, “এবার নববর্ষের ব্যবসা পুরোটাই মার খেয়েছে৷ আশা করেছিলাম, লকডাউন উঠে যাবে৷ আমাদের মতো ছোট কাপড় ব্যবসায়ীরা অন্তত ইদের ব্যবসাটা ঠিকমতো করতে পারবে৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে লকডাউন কবে উঠবে, কেউ বুঝতে পারছি না৷ বড়লোকের পয়সা আছে, গরিবরা অনেক জায়গা থেকে অনেক কিছু পাচ্ছে৷ কিন্তু আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্তের পরিস্থিতি শোচনীয়৷ আমার ছোট্ট দোকান৷ অন্যান্য বছর আমার ছোট্ট দোকানে ইদের মরশুমে 50 হাজার টাকার ব্যবসা হয়৷ এবার একটাকার ব্যবসাও হয়নি৷”