মালদা, 13 অক্টোবর : সন্ধে নেমে এসেছে। মহানন্দা ঘাট তখন সুনসান। আশপাশের জঙ্গলে থাকা শিয়ালের দল রাত জাগার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে হিংস্র শ্বাপদের চাপা গর্জন। ঠিক সেই সময়, গোধূলিবেলায় শালগ্রাম শিলা হাতে পুরোহিত ছুটছেন নদীর ঘাটে। রীতি মেনে জমিদারবাড়ির শালগ্রাম শিলাকে এই লগ্নেই নদীতে স্নান করাতে হবে। তারপর সেই শালগ্রাম নিয়ে তিনি চলে যাবেন নিজের বাড়িতে। অনেক পুরানো দৈনন্দিন রীতি। সেনবাড়ির শালগ্রাম শিলা তাঁর বাড়িতেই রাত কাটায়। পরদিন ভোরে নারায়ণ ফিরে যান জমিদারবাড়িতে। অব্রাহ্মণ জমিদার নিজেই শালগ্রাম শিলার জন্য বেঁধে দিয়েছিলেন এই রীতি।
দূর থেকে নদীর ঘাটে নৌকা বাঁধা রয়েছে দেখে খানিকটা আশ্চর্য হয়েছিলেন পুরোহিত। তখনও তিনি জানতেন না, তাঁর জন্য আরও আশ্চর্য অপেক্ষা করছে। ঘাটে পৌঁছে তিনি দেখেন, ওই নৌকা থেকে নেমে আসছেন এক সুন্দরী রমণী। সঙ্গে দুই ছেলে, দুই মেয়ে। ওই রমণী পুরোহিতের কাছে জমিদারবাড়ির রাস্তা জানতে চান। কিন্তু হাতে শালগ্রাম নিয়ে কথা বলা নিষেধ। তাই পুরোহিত ইঙ্গিতে ওই মহিলাকে জমিদারবাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দেন। এরপর শালগ্রামকে স্নান করিয়ে বাড়ি চলে যান তিনি। তবে তাঁর মনে প্রশ্ন থেকেই যায়, একা ছেলেমেয়ে নিয়ে নৌকায় ওই রমণী কীভাবে ঘাটে আসলেন? কোন মাঝিও তো নজরে এল না! পুরোহিত ভেবেছিলেন, পরদিন জমিদারবাড়িতে গিয়ে এনিয়ে তিনি তত্ত্বতালাশ করবেন।
পুরোহিতকে পরদিন এনিয়ে জমিদার বাড়িতে কাউকে প্রশ্ন করতে হয়নি। ততক্ষণে সবাই জেনে ফেলেছে, ওই রাতে দেবীর স্বপ্নাদেশ পান জমিদার মহেশচন্দ্র সেন। স্বপ্নে দেবী তাঁকে আদেশ দেন, ছেলেমেয়ে নিয়ে বাচামারি পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। জমিদার যেন মন্দির নির্মাণ করে তাঁকে স্থাপন করেন। পুজোর কিছু সামগ্রী তিনি নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। সেসব নদীর ঘাটে রয়েছে। ওই সামগ্রীগুলি যেন ঘাট থেকে তুলে আনা হয়। দেবীর আরও নির্দেশ, পঞ্চমুন্ডির আসনে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বপ্নে দেবীর নির্দেশ পেয়ে ঘুম মাথায় ওঠে জমিদার রমেশচন্দ্রের। ভোর হতেই লোকজন নিয়ে তিনি ছুটে যান ঘাটে। দেখেন, সত্যিই সেখানে পুজোর বেশ কিছু সামগ্রী, খড়্গ ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। সেসব বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি। এরপরই তিনি বাড়ির পাশে মন্দির নির্মাণ করেন। পঞ্চমুন্ডির আসন প্রস্তুত করা হয়। পত্তন হয় বর্তমানে জেলার অন্যতম প্রাচীন, বাচামারির সেনবাড়ির দুর্গাপুজো।
পুজো প্রবর্তনের ঠিক এই কাহিনিটাই বলছিলেন, বর্তমানে এই পুজোর ধারক, দাশগুপ্ত পরিবারের প্রবীণ সদস্য প্রলয়পতি দাশগুপ্ত। তিনি জানালেন, "এই পুজো শুধু পুরাতন মালদা নয়, জেলার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন। পুজো 500 বছরে পা দিল। গোটা জেলায় সেনবাড়ির পুজো নামে পরিচিত। তবে সেনদের কোনও বংশধর এখন আর বেঁচে নেই। অনেক আগেই সেই বংশ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। হয়ত পরবর্তীতে সেই বংশের মেয়েদের কোনও সন্তানের হাতে এই পুজোর ভার যায়। সেখান থেকে আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়। এখন আমরা এই বংশের পাঁচ পরিবার মিলে পুজো পরিচালনা করে আসছি। জমিদার মহেশচন্দ্র সেন প্রথমে ঘটে, তারপর পটে এবং শেষে মূর্তিপুজোর প্রচলন করেন। দেবীর স্বপ্নাদেশে তিনি মহানন্দার ঘাটে যেসব পুজোর সামগ্রী পেয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল দুটি পুষ্পপাত্র, একটি গাড়ু, একটি পানের বাটা, পাঁচটি খড়্গ সহ আরও কয়েকটি জিনিস। সেসব এখনও রয়েছে। শুরুর দিন থেকে প্রতিবছর এই জিনিসগুলি পুজোয় ব্যবহৃত হয়। দেবীর আদেশ অনুযায়ী এখনও ডাকের সাজে প্রতিমা তৈরি হয়। একবার মাটির সাজে প্রতিমা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বেদিতে তোলার পরেই প্রতিমা কালো হয়ে গিয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী, পঞ্চমীর দিন প্রতিমা বেদিতে ওঠেন। ষষ্ঠীতে কল্পারম্ভ। সপ্তমীর সকালে কলা বউ নিয়ে মহানন্দায় যাওয়া হয়। প্রাচীন রীতি মেনে আমাদের কলা বউ শাড়ি নয়, ঘাগড়া পড়ে নদীতে যান ও আসেন। পুজোর বোধন শুরু হয় কৃষ্ণা নবমী তিথি থেকে। এবার এক মাস পাঁচদিন ধরে চলছে সেই পুজো। প্রতিদিন চণ্ডীপাঠও চলছে। পুজোয় বলি প্রথা রয়েছে। মহানবমী তিথিতে পারিবারিক বলির পর অনেক মানুষ এখানে ছাগ বলি দেন। এই পুজোয় আগের মতো আর জৌলুস নেই, আড়ম্বর নেই, তবে আন্তরিকতা এখনও রয়েছে। এই পুজো শুধু আমাদের নয়, মালদাবাসীর পুজো।"
এবছরই প্রায় 500 বছরের পুরোনো মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছে নতুন মন্দির। ফলে এই পুজোর গা থেকে প্রাচীন গন্ধ যেন অনেকটাই উধাও। তার উপর এবার কোরোনা আবহ চলছে। ফলে অন্য বছরগুলিতে মানুষের যে ভিড় হয়, এবার তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছে এই পরিবার। পরিবারের অন্যতম সদস্য শুভেন্দু দাশগুপ্ত বলেন, "কোরোনার জন্য এবার আমরা মন্দিরের সামনে প্যান্ডেল খানিকটা বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাতে মানুষ একটু ফাঁকা দাঁড়াতে পারে। মাইকে অঞ্জলির মন্ত্র পড়া হবে। ভিড় এড়াতে একবারের জায়গায় তিন থেকে পাঁচবার মন্ত্র পড়া হবে। তবে প্রাচীন মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় ছিল না। 500 বছরের পুরোনো মন্দির ভেঙে পড়েছিল। রং-এর আস্তরণ প্রায় এক ইঞ্চি হয়ে গিয়েছিল। ছাদে বসে গিয়েছিল। গত বছর সপ্তমী তিথিতে বৃষ্টি হয়। ছাদ চুঁইয়ে মায়ের মূর্তিতে জল পড়ছিল। তাই আমরা পুরোনো মন্দির ভেঙে নতুন মন্দির তৈরি করেছি। তবে প্রাচীন পঞ্চমুন্ডির আসন অপরিবর্তিত রয়েছে। পুরোনো বেদির উপর শুধু পাথর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।"
মালদা জেলার প্রাচীনতম দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে অন্যতম পুরাতন মালদা পৌরসভার 7 নম্বর ওয়ার্ডের বাচামারি এলাকার সেন বংশ প্রবর্তিত এই পুজো। বর্তমানে দাশগুপ্ত পরিবারের সদস্যদের হাত ধরেই সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে জেলার ইতিহাসের এক অধ্যায়।