কলকাতা ও শিলিগুড়ি, 22 অক্টোবর : সামনেই বিধানসভা নির্বাচন । আর তার আগে ফের একবার সরগরম রাজ্য রাজনীতি । সৌজন্য মোর্চা নেতা বিমল গুরুং । গতকালই কলকাতায় রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক করে NDA জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তিনি । তৃণমূলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চান বলে জানিয়েছেন তিনি । তৃণমূলের পক্ষ থেকে তাতে সম্মতিও জানানো হয়েছে ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পাহাড়ের রাজনীতি আর মোর্চা একে অন্যের পরিপূরক । বিধানসভা ভোটের আগে গুরুং শিবিরের এই চাল নিশ্চিতভাবে পাহাড়ের রাজনীতিতে বড়সড় প্রভাব ফেলবে । কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন বিমল গুরুং ? কী বলছেন তাঁর একসময়ের ছায়াসঙ্গী তথা পাহাড়ের জন আন্দোলন পার্টির নেতা হরকা বাহাদুর ছেত্রী ?
পাহাড়ের জন আন্দোলন দলের নেতা হরকা বাহাদুর ছেত্রী ETV ভারতকে বলেন, "বিমল গুরুঙের কাছে কোনও বিকল্প ছিল না । দিল্লি থেকে কোনও সাড়া পাননি । তিন বছরের মধ্যে বুঝতে পেরেছেন BJP কিছু করবে না । ওর বাড়ি ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে BJP । গোর্খাল্যান্ড নিয়েও কিছু বলছে না । শুধু নির্বাচনের সময় ওকে ব্যবহার করে । 2021 সালে যদি আবারও তৃণমূল ক্ষমতায় আসে তাহলে দার্জিলিঙে ঢুকতে পারবে না । সেকারণে আগে থাকতে হাত মেলালেন । যাতে অন্তত পাহাড়ে ফেরা যায় ।"
হরকা বাহাদুর ছেত্রী অবশ্য মনে করেন গোর্খাল্যান্ড এখন বিমল গুরুঙের কাছে সেকেন্ডারি ইশু । এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, "গুরুঙের কাছে এখন নিজেকে বাঁচানো বড় বিষয় । এ-ছাড়া কোনও উপায় ছিল না । অনেকগুলি মামলা রয়েছে । UAPA ধারা রয়েছে ।" গুরুঙের রাজনৈতিক অবস্থান বদলালেও তাঁর সঙ্গে আর নিজেকে মেলাতে চাইছেন না হরকা বাহাদুর । তিনি স্পষ্ট জানালেন, "নিজের প্রতিষ্ঠিত জন আন্দোলন পার্টি এককভাবে নির্বাচনে লড়াই করবে । পাহাড়ের মানুষের হয়ে কথা বলবে ।"
আরও পড়ুন : বিমল গুরুং আগে বুঝলে 13 জনের প্রাণ যেত না : মুকুল রায়
গুরুঙের প্রত্যাবর্তন নিয়ে অবশ্য মেপে পা ফেলতে চাইছে রাজনৈতিক দলগুলি । শিলিগুড়িতে বহু চেষ্টাতেও কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব । প্রতিক্রিয়া মেলেনি বিনয় তামাঙেরও । পাহাড়ে ফিরলে কি ফের তাঁর হাতেই যাবে GTA-র মসনদ? ফোনে ও মেসেজে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কোনও উত্তর দেননি বিনয় তামাং ।
তবে বিনয় তামাং অনুগামী মোর্চার মুখপাত্র সতীশ পোখরেল টেলিফোনে জানিয়েছেন, "পদের লোভেই এভাবে হঠাৎ ভোলবদল করেছেন গুরুং । এখনও যাঁরা গুরুং ভক্ত, তাঁরাই ভেবে দেখুন গুরুং প্রত্যাবর্তনের নেপথ্য কারণ কী !"
এদিকে বিমল গুরুং তৃণমূলে যোগদানের যে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন, তাতে সম্মতি জানিয়েছে রাজ্যের শাসক শিবিরও । তবে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তা নিয়ে হতবাক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা । অনেকেই বলছেন মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত তাঁর কাছে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে । রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমল মুখোপাধ্যায় জানালেন, "মুখ্যমন্ত্রীর মিস অ্যাডভেঞ্চার" বিমল গুরুঙের সঙ্গে থাকা । সমগ্র বিষয়টাকে তিনি "মিস ফায়ার" বলে অভিহিত করেছেন । বিমল গুরুং একক অ্যাজেন্ডায় ভরসা করে পাহাড়ের রাজনীতি করেছেন । মূলত গোর্খাল্যান্ডের দাবি ছিল তাঁর । অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিরকালই এ রাজ্যকে টুকরো করার বিরোধী ছিলেন । এখন যদি গোর্খাল্যান্ডের প্রস্তাব তিনি মেনে নেন তাহলে রাজ্যের মানুষের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছাবে না বলে মন্তব্য করেন অমল মুখোপাধ্যায় ।
আরও পড়ুন : বিমল গুরুং তৃণমূল ও BJP-র অভ্যন্তরীণ বিষয়, বলছে বাম-কংগ্রেস
তিনি আরও বলেন," মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই স্ট্রাটেজি অত্যন্ত ভুল । তাহলে কি আমরা ধরে নেব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিমল গুরুংকে আশ্বাস দিয়েছেন গোর্খাল্যান্ডের? কেবল ভোট নেওয়ার তাগিদে এই ভাবনা চিন্তা । তবে রাজ্যের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ভাবনা চিন্তাকে সঠিকভাবে মেনে নেবে না । শেষ পর্যন্ত এটা ব্যাক ফায়ার করবে ।"
অতীতে তাঁকে খুঁজতে নেপাল পর্যন্ত গেছিল পুলিশ । এমন মানুষ সকলের সামনে হোটেলে বসে সাংবাদিক বৈঠক করছেন খোদ কলকাতায় । গতকালের ঘটনায় রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন IG পঙ্কজ দত্ত বলছেন, "এই জিনিস মেনে নেওয়া যায় না । আগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পেশ করা উচিত ছিল । তাঁকে যদি গ্রেপ্তার না করা হয় তবে পুলিশের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে । "
দীর্ঘ তিন বছর পলাতক থাকার পর গতকাল হঠাৎ উদয় হন বিমল গুরুং । তাঁর সঙ্গে ছিলেন রোশন গিরি সহ অন্য পারিষদরাও । তাঁদের বিরুদ্ধেও জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রয়েছে । তাঁদের প্রথমে দেখা যায় গোর্খা ভবনের সামনে । পরে শহরের একটি পাঁচতারা হোটেলে সাংবাদিক বৈঠক হয় । সেখানে তিনি NDA জোট ছাড়ার কথা ঘোষণা করেন । প্রচ্ছন্নভাবে নিজের আগের অবস্থান থেকে 180 ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে আগামী দিনে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে লড়ার ইচ্ছার কথাও ঘোষণা করেন ।
আরও পড়ুন : গুরুংয়ের NDA-র প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত, টুইট তৃণমূলের
বিমল গুরুঙের এই হঠাৎ আবির্ভাব প্রশ্ন তুলে দিয়েছে পুলিশ মহলে । প্রাক্তন পুলিশ কর্তা পঙ্কজ দত্ত এ-প্রসঙ্গে বলেন, "অমিতাভ মালিকের মৃত্যুর জন্য প্রধান অভিযুক্ত যদি শাস্তি না পায় তবে পুলিশ মহলে তার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে । এমন একজন ব্যক্তি যাঁর বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিস পর্যন্ত রয়েছে, তাঁকে সবার আগে গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল । আদালতে পেশ করার পর তিনি জামিন পেলে যে কোনও রাজনীতি করলে কিছু বলার নেই । কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি । তাঁকে গ্রেপ্তার করা না হলে পুলিশের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে ।"